হরিশ্চন্দ্র বললেন, “কুড়ি টাকা! ঠিক শুনছি তো!”
“ঠিকই শুনছেন। আমার একটু টানাটানি হবে বটে, কিন্তু
আপনার দিকটাও তো দেখতে হবে। রাজবাড়ির যা অবস্থা দেখছি, তাতে ওর বেশি চাইলে ধর্মে সইবে না।”
হরিশ্চন্দ্র খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বললেন, “আরও কথা আছে। বাপু, এ বাড়ির খাওয়াদাওয়া তেমন সুবিধের নয়। কচু-ঘেঁচু দিয়ে একটা ঝোল আর মোটা চালের ভাত।”
লোকটা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে বলে, “ভাতের সঙ্গে ঝোল! বলেন কী রাজামশাই! সে তো রাজভোগ! আমার তো ভাত-পাতে একটু নুন-লঙ্কা হলেই চলে।”
হরিশ্চন্দ্ৰ হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “বুঝেছি বাপু, তোমার একটা মতলব আছে।”
ছোঁকরা ভারী লাজুক হেসে মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলল, “এ বয়সেও কর্তামশাইয়ের চোখের নজর আছে বটে! ঠিকই ধরেছেন কর্তা, একটু বিষয়কর্মেই চৈতন্যপুরে আসা। শুনেছিলুম, চৈতন্যপুরের রাজবাড়ি হল অবারিত দ্বার।”
হরিশ্চন্দ্র আর একটা শ্বাস মোচন করে বললেন, “ঠিকই শুনেছ বাপু, অবারিত দ্বারই বটে। সিংহদরজার লোহার ফটক কবেই ভেঙে পড়ে গিয়েছে। বাড়ির বেশিরভাগ দরজারই খিল নেই। জানলার কপাট উধাও। গোরু-ছাগল, কুকুর-বেড়াল, চোর-ছ্যাঁচড় সবই ঢুকে পড়ছে। এমন অবারিত দ্বার আর কোথায় পাবে। তবে কিনা গা ঢাকা দেওয়ার পক্ষে জায়গাটা মন্দ নয়। তোমার বোধ হয় সুবিধেই হবে।”
ছোঁকরা তাড়াতাড়ি হরিশ্চন্দ্রের পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, ওই ভরসাতেই আসা কিনা। আমার নাম হীরেন গণপতি। হিরু বলেই সবাই ডাকে।”
ছোঁকরা চোর বা ডাকাত, ফেরারি আসামি বা উগ্রবাদী, খুনি বা গুন্ডা কি না তা কে জানে! কিন্তু হলেই বা, হরিশ্চন্দ্রের কী-ই বা
যায় আসে। এই বাড়িতে স্বদেশি আমলেও ছেলে-ছোঁকরা ঢুকে বোমা বাঁধত। অন্তত দু’বার দুটো জেল-পালানো ডাকাত কাজের লোক সেজে ঢুকেছিল, পরে খুঁজে খুঁজে পুলিশ এসে তাদের ধরে নিয়ে যায়। এত বড় একটা বাড়ি সামাল দেওয়ার মতো লোকবল তাঁর কই? তাই তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাত্র।
কিন্তু মাঝরাতে এক বিপত্তি। খ্যানখ্যানে গলায় কে যেন ডাকছিল, “ও হরি! বলি হরিশ্চন্দ্র কি শুনছিস! কী কুম্ভকর্ণের ঘুম রে বাবা তোর! বলি ওদিকে যে সব্বোনাশ হয়ে গেল, সে হুশ আছে?”
হরিশ্চন্দ্র ধড়মড় করে উঠে দ্যাখেন, তিন ডাইনি বুড়ি খাটের তিন দিকে দাঁড়িয়ে কটমট করে তাঁকে দেখছে। হরিশ্চন্দ্র অবশ্য ঘাবড়ালেন না। এই তিনজনকে তিনি বিলক্ষণ চেনেন। ছেলেবেলা থেকেই। তিনজনেই দেড়শো বছর আগে গত হয়েছে। কিন্তু এ বাড়ির মায়া কাটাতে পারেনি। মাঝে মাঝেই উদয় হয়ে নানা বায়নাক্কা তোলে। হরিশ্চন্দ্র শশব্যস্তে বললেন, “কী হয়েছে। পিসিমাগণ?”
কানা পিসির একটা চোখ কানা বটে, কিন্তু আর-এক চোখের নজর এমনই সাংঘাতিক যে, অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। কানা পিসি ঝংকার দিয়ে বলল, “বলি, তুই এই সসাগরা পৃথিবীর রাজা, চারদিকে তোর এত ধন্যি ধন্যি, সেই তুই কিনা যাকে-তাকে রাজবাড়িতে সেঁধুতে দিচ্ছিস বাবা! চৈতন্যপুরের রাজবাড়ি কি শেষে ধর্মশালা হয়ে উঠবে নাকি?”
কুঁজো পিসির পিঠের কুঁজ যত বড়ই হোক, তেজ কিছু কম নয়। চোখ পাকিয়ে বলে উঠল, “চৈতন্যপুর হল গিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রাজ্য। আর তুই হলি রাজচক্রবর্তী। সেই তোরই শেষে মতিচ্ছন্ন হল! ছোঁড়াটা যদি আমাদের গয়নাগাঁটির খোঁজে এসে থাকে, তা হলে কী হবে বল তো?”
খোঁড়া পিসির এক ঠ্যাং খোঁড়া বটে, কিন্তু মেরুদণ্ড খাড়া আর গলার জোর সবচেয়ে বেশি। ঝংকার দিয়ে বলল, “লোকে বলে মহারাজাধিরাজ হরিশ্চন্দ্র হল গে একটা রাজার মতো রাজা। যেমন বুদ্ধি, তেমন বিবেচনা। তা কোথায় কী? এরপর তো রাজবাড়িতে হাট-বাজার বসে যাবে।”
কানা পিসি এবার গলাটা একটু নরম করে বলে, “হ্যাঁ রে হরি, বলি আমাদের তিন-চার হাজার ভরির গয়না, তিন কলসি হিরে জহরত, সাতশো আকবরি মোহর কার জন্য আগলে রেখেছি বল তো! তুই ছাড়া আমাদের আছেটা কে? তোকেই সব দিয়ে থুয়ে যাব বলেই না সব সময় ভয়ে-ভয়ে থাকি, অন্য কেউ এসে না লুটেপুটে নিয়ে যায়। তা বাছা, এইসব অজ্ঞাতকুলশীলকে কি প্রাসাদে ঢোকাতে আছে?”
সোনাদানার গল্প সেই ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছেন হরিশ্চন্দ্র। পিসিমারা নাকি তাঁকেই সব দিয়ে যাবে, কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি পয়সাও উপুড়হস্ত করেনি। এতকাল খুব আশায়-আশায় ছিলেন, কিন্তু এখন আশা ক্ষীণ হতে হতে উবে যেতে বসেছে। তবে এদের তিনি চটাতেও সাহস পান না। কী জানি যদি সত্যিই একদিন লুকোনো সোনাদানা বের করে দেয়! তা হলে কী হবে? অনেক ভেবে দেখেছেন হরিশ্চন্দ্র। সোনাদানা পেলে এই বয়সে তিনি এক জোড়া নরম দেখে বিদ্যাসাগরী চটি কিনবেন, একটা ঝলমলে দেখে জরির জোব্বা, দাঁতগুলো বাঁধিয়ে নেবেন, আর দু’বেলা ভাতের পাতে একটু আমসত্ত্ব খাবেন। এর বেশি ভাবতে তাঁর ভরসা হয় না।
হরিশ্চন্দ্ৰ হাতজোড় করে বললেন, “পিসিমাগণ, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনাদের সোনাদানা খুঁজে বের করার মতো মনিষ্যি এখনও জন্মায়নি। সেই গাঁড়া সর্দারের কথা মনে নেই? সে আমাদের সবাইকে বেঁধে রেখে দক্ষিণের ঘরের মেঝে খুঁড়ে গর্ত করেছিল! তা আপনারা তো মাটিচাপা দিয়ে তাদের মেরেই ফেলেছিলেন প্রায়। বাড়িতে একটা অপঘাত হতে যাচ্ছে দেখে রাখহরি তাদের উদ্ধার করে।”