রাখহরি বলল, “গা তো দিব্যি গরম, খাসও চলছে, নাড়িও ঠিক আছে। কিছু হয়নি আপনার।”
“হয়নি! নাকটা ভেঙে গিয়েছে না?” মোক্ষদা ঝংকার দিয়ে বলল, “নাক ভাঙুক আপনার শরদের।”
হরিশ্চন্দ্র চারদিকে ভাল করে তাকিয়ে বললেন, “তবে লোহার বলগুলো কোথায় পড়ল বল তো?”
“কীসের লোহার বল?”
“ওই যে লোকটা লোহার বল লোফালুফি করতে করতে হঠাৎ ছেড়ে দিল!”
“আপনি স্বপ্ন দেখছিলেন। এখন ঘুমোন তো৷” সকালবেলা হরিশ্চন্দ্র তাঁর জরির পোশাকটা পরে বাগানে পায়চারি করছিলেন। পোশাকের জরি অবশ্য প্রায় সবই খসে গিয়েছে, কাপড়টাও ঝ্যালঝালে হয়ে এসেছে। পুরনো ঠাটবাট আর কিছুই বজায় রাখা যাচ্ছে না। তবু বড্ড মায়া। এই পোশাকটা তাঁর ঠাকুরদা পরেছেন, বাবা পরেছেন, তাই তিনিও পরেন। বাগানটাও আর বাগানের মতো নেই। আগাছা, চোরকাঁটায় ভরতি। পাথরের ফোয়ারাটা কেতরে পড়ে আছে। তবু তো বাগান।
একটু অন্যমনস্ক ছিলেন, আচমকা একটা লোক তাঁর পথ আটকে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বলল, “প্রাতঃপ্রণাম বুড়োকর্তা।”
হরিশ্চন্দ্র একটু অবাক হয়ে বলেন, “তুমি কে হে বাপু? কী চাও?”
“আজ্ঞে, বলছিলুম কী, আপনার বাড়িতে একটা ছোটখাটো কাজ হয়?”
হরিশ্চন্দ্র বিলক্ষণ জানেন যে, আজকাল তিনি ভুল দেখেন, ভুল শোনেন, ভুল বোঝেন এবং ভুল বলেও ফেলেন। তাই খুব সতর্ক হয়ে তিনি লোকটাকে দেখে নিয়ে বললেন, “বাপু হে, আগে এ বাড়িতে জুতো পরিয়ে দেওয়ার লোক ছিল, ঘামাচি গেলে দেওয়ার লোক ছিল, চুল আঁচড়ে দেওয়ার লোক ছিল, এমনকী, গোঁফে তা দিয়ে দেওয়ার জন্যও লোক ছিল। কিন্তু সেই দিন আর নেই হে।”
লোকটা ভারী খুশি হয়ে বলে, “আজ্ঞে, আমি ওসব কাজ খুব ভালই করতে পারি কর্তা।”
হরিশ্চন্দ্র বিরস মুখে বললেন, “ওরে বাপু, জুতো পরাবে কাকে? আমার তো মোটে এই এক জোড়া হাওয়াই চপ্পল সম্বল। বয়স হওয়ার পর শীত-গ্রীষ্ম সব সময়েই কেমন শীত শীত করে বলে আমার ঘামও হয় না, ঘামাচিও নেই। আর চুল আঁচড়াতে চাইলেই তো হবে না, চুল কোথায়? দেখছ না, মাথাজোড়া টাক? আর গোঁফে উকুন হয়েছিল বলে বছর চারেক আগেই হারাধন হাজাম আমার গোঁফ কামিয়ে সাফ করে দিয়ে গিয়েছে। তা দেবে কোথায়?”
“রাজামশাই, আমি যে অনেক দূর থেকে বড় আশা করে এসেছিলুম।”
হরিশ্চন্দ্র ফের পায়চারি শুরু করে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “না হে ভালমানুষের ছেলে, আমি তো আশা-ভরসা কিছুই দেখছি না।”
“তা রাজামশাই, আপনার রসুইকর লাগে না? আমি রোগন জুস, দম পুক্ত, মুর্গ মসল্লম, কাবাব, বিরিয়ানি, চাইনিজ, মোগলাই সব রাঁধতে পারি।”
হরিশ্চন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “আহা, কতকাল ওসব শব্দ শুনিইনি! কী যেন বললে বাপু? রোগন জুস, কাবাব, বিরিয়ানি?”
“যে আজ্ঞে।”
হরিশ্চন্দ্র হাতটা উলটে মাথাটা নাড়া দিয়ে বললেন, “স্বাদ সোয়াদ ভুলেই গিয়েছি।”
“একবার ট্রাই দিয়ে দেখুন কর্তা, ফাটিয়ে দেব।”
“ওরে ভালোমানুষের পো, পেটে যে কিছুই সয় না বাপ। মোক্ষদা দু’বেলা গাদাল পাতা দিয়ে কাঁচকলার ঝোল বেঁধে দেয়। সেই আমার পথ্যি। একদিন এক টুকরো পাঁঠার মাংস খেয়ে ফেলে সে কী আইঢাই! না হে বাপু, ও লাইনে সুবিধে নেই তোমার।”
লোকটা হরিশ্চন্দ্রের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তা হলে তো বড় মুশকিলে পড়া গেল মশাই। আমি যেন শুনেছিলুম, রাজা গজাদের মেলাই লোকলশকর লাগে! আর এই চৈতন্যপুরের রাজবাড়িতে নাকি মোটে পাঁচজন কাজের লোক। তারাও সব বুড়োধুড়ো হয়ে পড়েছেন। তাই ভাবলুম, আপনার একজন কমবয়সি কাজের লোক হলে বোধহয় ভালই হয়।”
হরিশ্চন্দ্র ঠোঁট উলটে বললেন, “কাজের আছেটাই বা কী বলো তো! আমি তো বাপু, সারাদিন শুয়ে-বসে থাকা ছাড়া কোনও কাজই খুঁজে পাই না। তুমিই কি পাবে?”
লোকটা সোৎসাহে বলল, “কাজ মেলাই জানি বুড়োকর্তা, গাছ বাইতে পারি, জল তুলতে পারি, মাটি কোপাতে পারি, কাপড় কেচে ইস্তিরি করতে পারি, পাঞ্জাবি গিলে করতে পারি, তারপর বাজার-হাট বলুন, ফাঁইফরমাশ বলুন, সব কাজে পাকা। দরকার হলে লাঠি চালাতে পারি, বন্দুক ফোঁটাতে পারি।”
হরিশ্চন্দ্র থমকে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখ করে লোকটাকে দেখে নিয়ে বললেন, “ওরে বাবা, তোমার তো অনেক বিদ্যে হে! কিন্তু এত গুণের কদর করতে পারি, আমার কি আর সেই সঙ্গতি আছে? আমার কাজের লোকেরা কত বেতন পায় জানো? গত পঞ্চাশ বছর ধরে তারা ত্রিশ টাকা করে মাইনে পায়। তাও সব মাসে হাতে পায় না। মাঝেমধ্যেই বাকি পড়ে যায়।”
লোকটা ভারী অবাক হয়ে বলে, “ত্রিশ টাকা! ত্রিশ টাকা কি কম হল মশাই? ঠিক মতো দরাদরি করে কিনলে যে ত্রিশ টাকায় জাহাজ কেনা যায় রাজামশাই।”
হরিশ্চন্দ্র বুঝতে পারছেন, তিনি ভুল শুনছেন। প্রায়ই শোনেন। তবু ভ্রু কুঁচকে বললেন, “জাহাজ বললে নাকি বাপু?”
“যে আজ্ঞে। আমাদের গাঁয়ের গৌর গড়গড়ি তত তিন টাকায় হাতি কিনে ফেলেছিল।”
হরিশ্চন্দ্র ডান কানে আঙুল দিয়ে খোঁচাখুঁচি করে হতাশ মাথা নেড়ে বললেন, “নাহ, কানটাই গিয়েছে দেখছি!”
লোকটা সোৎসাহে বলল, “গৌর গড়গড়ি এমন দরাদরি করেছিল যে, হাতিওয়ালা দরাদরির চোটে মূৰ্ছা যায়। মূৰ্ছা ভাঙার পর তার মাথা এমন ভ্যাবলা হয়ে গিয়েছিল যে, তিন টাকায়ই হাতিটা বেচে দিয়ে মনের দুঃখে নিরুদ্দেশে চলে যায়। বুঝলেন তো রাজামশাই, ত্রিশ টাকায় হিসেব মতো দশটা হাতি কিনে ফেলাও বিচিত্র নয়। ত্রিশ টাকা যদি বেশি বলে মনে হয়, তা হলে আমাকে না হয় আপনি কুড়ি টাকাই দেবেন।”