“কিন্তু ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলে। আর বাক্সটাও তাকে ফেরত দাওনি।”
“আহা, বাক্সের যা ছিরি, ওটা বিক্রি করলেও আমার চুরির জিনিসের দাম উঠত না।”
“কিন্তু বাক্সখানার কদর যে বেড়েছে মন্টুরাম। ও বাক্সে যা আছে, তার যে অনেক দাম!”
“দূর দূর! ও ছাইভস্মের আবার দাম কী?”
“আছে হে মন্টুরাম, আছে। তোমার মতো পাপী-তাপীরা ওর মর্ম বুঝবে না হে।”
২. মাঝরাতে হরিশ্চন্দ্র চোখ চেয়েই
মাঝরাতে হরিশ্চন্দ্র চোখ চেয়েই আঁতকে উঠে চেঁচালেন, “ওরে করিস কী? করিস কী? ও যে সব্বোনেশে কাণ্ড! হাত ফসকে যদি আমার গায়ে এসে পড়িস, তা হলে যে আমার বুড়ো হাড় একটাও আস্ত থাকবে না!”
কিন্তু কে শোনে কার কথা! লোকটা সেঁতো একটা হাসি হেসে দিব্যি ফের এক ঝাড়বাতি থেকে ঝুল খেয়ে শূন্যে দুটো ডিগবাজি দিয়ে অন্য ঝাড়বাতিটায় গিয়ে দোল খেতে লাগল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন হরিশ্চন্দ্র। কিন্তু তাতেও কি শান্তি আছে! ফের চোখ খুলতেই সেই একই দৃশ্য। লোকটা এবার ওই ঝাড়বাতি থেকে লাফ মেরে শূন্যে চরকির মতো কয়েকটা পাক খেতে লাগল। হরিশ্চন্দ্র আর্তস্বরে বললেন, “ওরে বাপু, ট্রাপিজের খেলা দেখাতে চাস তো বাগানে মেলা গাছপালা রয়েছে, সেখানে যা না! এই বুড়ো মানুষটার বুকের উপর কেন?”
লোকটা অবশ্য পড়ল না। দিব্যি অন্য ঝাড়বাতিটায় গিয়ে ঝুলে এক গাল হেসে বলল, “কেমন খেলা রাজামশাই?”
হরিশ্চন্দ্র কাতরস্বরে বললেন, “এ কি তোর সার্কাসের তাঁবু পেয়েছিস বাপু? ঝাড়বাতি যে বড্ড পলকা জিনিস। লাফঝাঁপের ধাক্কা কি সইতে পারবে? ভেঙে পড়লে রক্তারক্তি কাণ্ড হবে যে!”
হরিশ্চন্দ্রের খাটের উপর, উঁচুতে একটা সিলিং পাখা ঝুলে
আছে। সারানো হয়নি বলে এখন আর চলে না। লোকটা ঝাড়বাতি ছেড়ে এক লাফে গিয়ে পাখাটার উপর পা ঝুলিয়ে বসল। আতঙ্কিত হরিশ্চন্দ্র ইষ্টনাম জপ করতে করতে বললেন, “নাঃ, দেখছি অপঘাতেই আমার প্রাণটা যাবে।”
লোকটা ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে বলে, “বুঝলেন রাজামশাই, আমি একসময় নামকরা ট্রাপিজের খেলোয়াড় ছিলুম। একবার অসাবধানে পড়ে গিয়ে বাঁ হাতটা ভেঙে গিয়েছিল বলে ছেড়ে দিতে হল।”
“তা বাপু, ওসব হুড়যুদ্ধের খেলায় যাওয়ার দরকারটাই বা কী তোমার? দুনিয়ায় কি আর কোনও খেলা নেই? ফুটবল-টুটবল খেলো, ব্যাট-বল খেলো, তাস বা পাশা না হয় লুডু খেললেও তো হয় রে বাপু।”
“ট্রাপিজের খেলায় ভারী মজা রাজামশাই, ও আপনি বুঝবেন। খেলাটা ছেড়ে দিতে হল বলেই শেষে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতাম।”
“ভাল রে বাপু, খুব ভাল। ম্যাজিকও কিছু খারাপ নয়।”
“দেখবেন নাকি রাজামশাই?” বলেই লোকটা ওই উঁচু থেকে সোজা হরিশ্চন্দ্রের খাটের উপর লাফ দিয়ে নামল। হরিশ্চন্দ্র “বাবা রে, গেছি রে!” বলে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। লোকটার অবশ্য ভ্রুক্ষেপ নেই।
হরিশ্চন্দ্রের দু’ধারে দু’পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠিক তার বুকের উপর ছ’-সাতটা লোহার বল লোফালুফি করতে লাগল।
হরিশ্চন্দ্র হাউমাউ করে উঠলেন, “সামলে বাপু, সামলে! এ যে প্রাণঘাতী খেলা রে বাবা! কেমন বেআক্কেলে লোক হে তুমি! রাজা-গজাদের বিছানায় পা দিয়ে দাঁড়িয়েছ যে বড়! রাজার কি সম্মান নেই?”
লোকটা বলগুলো লোফালুফি করতে করতেই বলল, “আপনি আর কীসের রাজা? রাজত্ব নেই, মন্ত্রীসান্ত্রি নেই, হাতি-ঘোড়া নেই। কেউ মানেও না আপনাকে।”
হরিশ্চন্দ্ৰ ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “রাজা না হোক, বুড়ো মানুষ বলেও তো একটু মায়া করতে হয় রে বাপু। ওই লোহার বল একটাও যদি হাত ফসকে পড়ে, তবে কি আমি বাঁচব?”
লোকটা নির্বিকার ভাবে বল লুফতে লুফতে বলে, “ভয় নেই রাজামশাই, আমার হাত থেকে বল ফসকায় না। এই দেখুন, বলগুলো সব উপরে ছুঁড়ে ছেড়ে দিচ্ছি, সব অদৃশ্য হয়ে যাবে।”
বলতে বলতেই লোকটা একের পর-এক বল উপরে ছুঁড়ে দিয়ে খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে গেল। হরিশ্চন্দ্র সভয়ে দেখলেন, বলগুলো সোজা তাঁর উপর নেমে আসছে। একটা বল এসে পড়ল কপালে, দ্বিতীয়টা নাকে, তিন নম্বরটা বুকে, চার নম্বরটা পেটে, আর দুটো কোথায় পড়ল কে জানে। হরিশ্চন্দ্র বললেন, “ওরে বাবা রে! মাথাটা গেল! নাকটা আর নেই রে! বুকটা তো ভেঙে চুরমার, পেটটা ফুটো হয়ে গিয়েছে রে!”
হরিশ্চন্দ্র চোখে অন্ধকার দেখলেন। তারপর গায়ে হাত দিয়ে দেখলেন গা বরফের মতো ঠান্ডা, নাকে হাত দিয়ে দেখলেন, উঁহু, খাস বইছে না। নাড়ি টিপে দেখলেন, নাড়ি থেমে গিয়েছে, বুকে হাত দিলেন, না, ধুকপুকুনি নেই।
হরিশ্চন্দ্র হাউরে মাউরে করে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওরে তোরা কে কোথায় আছিস, শিগগির আয়। আমি যে মরে কাঠ হয়ে গিয়েছি। মড়া বাসি হওয়া কি ভাল রে! তাড়াতাড়ি আয়। এটা কি ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোনোর সময়! একটা লোক মরে গেল আর তোদের হুঁশ নেই? মুখাগ্নি করার জন্য একটা দেশলাই দে বাপ, কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলি, দেরি হলে অনৰ্থ হবে যে!”
চেঁচামেচি শুনে বুড়ো রাখহরি, মোদা, নগেন সব কাজের লোকেরা হাজির।
“কী হল বুড়োকর্তা, চেঁচাচ্ছেন কেন?”
“তোদের আক্কেলটা কী বল তো! শ্মশানবন্ধুদের সব ডেকে আন, মড়ার খাট কিনতে লোক পাঠিয়ে দে।”
“বালাই ষাট! আপনার হয়েছে কী?”
“মরে গিয়েছি তো! এই দ্যাখ নাড়ি বন্ধ, শ্বাস নেই, গা ঠান্ডা, ধুকপুকুনি হচ্ছে না।”