মন্টুরামবাবু হঠাৎ হুংকার দিয়ে উঠলেন, “বাক্স! কীসের বাক্স? কোথায় বাক্স? কার বাক্স? কবেকার বাক্স? বাক্স বললেই হল? বাক্স কি গাছে ফলে? কোথাকার কোন মদন তপাদার, তার কীসের না কীসের বাক্স, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা কীসের হা? বাক্সে কী আছে তা কি আমার জানার কথা? সেই বাক্স চোখেই দেখলুম না।” সুধীর সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়ে বলে, “আজ্ঞে, সে তো ঠিক কথাই। মদন তপাদারের বাক্স নিয়ে আমাদের মতো মনিষ্যির মাথাব্যথা কীসের? তবে কিনা কালোবাবু, ল্যাংড়া গেনু, ফুটু সর্দাররা ওই বাক্সটার জন্য বড়ই হন্যে হয়ে পড়েছে।”
মন্টুবাবু হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “ল্যাংড়া গেনু আর ফুটু সর্দার আবার কোথা থেকে উদয় হল?”
“আজ্ঞে, তাঁরা উদয় হয়েই আছেন। শ্রদ্ধাস্পদ কানাই দারোগামশাই এই দু’জনের যাতে সন্ন্যাস রোগ বা সর্পাঘাতে মৃত্যু হয়, তার জন্য হটুগঞ্জের জাগ্রত কালীবাড়িতে দু’জোড়া পাঁঠা মানত করে রেখেছেন। এই আক্রার বাজারে দু’ জোড়া পাঁঠার দামটাও একটু ভেবে দেখুন। তা হলেই বুঝতে পারবেন এ দু’জনের এলেম কত।”
“তুমি কি বলতে চাইছ, এই দু’জনেও মদন তপাদারের বাক্সের খদ্দের?”
“পরিপাটি বুঝতে পেরেছেন মশাই। বাক্সের তল্লাশে তিন পক্ষই আসরে নেমেছেন। তিনজনের যে-কোনও সময়ে খুনোখুনি হয়ে যেতে পারে। তা হলেই ভেবে দেখুন, মদন তপাদারের বাক্সখানা কী সাংঘাতিক জিনিস!”
মন্টুরামবাবু ভারী বিরক্ত হয়ে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভাব করে বললেন, “দুর, দূর! আহাম্মক আর কাকে বলে। বাক্স বলতে তো একটা পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া চামড়ার সুটকেস! তার মধ্যে বোকা লোকদের বুরবক বানানোর সব এলেবেলে সস্তা জিনিস! ওর জন্য কেউ হেঁদিয়ে মরে নাকি? ছ্যা ছ্যা! তুমি বরং গিয়ে ওদের বেশ ভাল করে বুঝিয়ে বোলো যে, ও বাক্সে তেমন কিছু নেই। ওদের কেউ ভুল খবর দিয়েছে।”
“সে বলবখন। ছেঁড়াখোঁড়া চামড়ার পুরনো একটা সুটকেস তো? তা বাক্সটা কতটা বড় হবে বলুন তো কর্তা!”
মন্টুরামবাবু অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, “তার আমি কী জানি! সুটকেস কি আমি দেখেছি নাকি? চামড়ার বাক্স না টিনের বাক্স, তা কি আমার জানার কথা? আবোল তাবোল বকে আমার মাথাটা আর গুলিয়ে দিয়ো না তো বাপু। কোথাকার কোন মদন তপাদার আর তার কোন না-কোন সুটকেস? ভাল জ্বালা হল দেখছি।”
ঠিক এই সময়ে মন্টুরামবাবুর গিন্নি হরিমতী ঘরে ঢুকে আঁতকে উঠে বললেন, “ওমা! এটা আবার কে গো?”
মন্টুরামবাবু ভারী তেতো গলায় বললেন, “আর বোলো না, এটা একটা চোর।”
হরিমতী ড্যাবড্যাব করে খানিকক্ষণ সুধীর গায়েনের দিকে চেয়ে দেখে হঠাৎ ভারী আহ্লাদের গলায় বললেন, “ওমা! কী সুন্দর ছোট্টখাট্টো পুতুল-পুতুল চোর গো! কেমন গোপাল গোপাল চেহারা। ইচ্ছে করছে, আমার পুতুলের আলমারিতে সাজিয়ে রাখি!”
একথা শুনে সুধীর কঁকিয়ে উঠে হাতজোড় করে বলে, “না মাঠান, আলমারিতে আর না, আলমারি বড় ভয়ংকর জিনিস।”
মন্টুরামবাবু গম্ভীর গলায় হরিমতী দেবীকে বললেন, “আর আশকারা দিয়ো না তো। একে পুলিশে দেব।”
হরিমতী মন্টুরামের দিকে তাকিয়ে ঝংকার দিয়ে বললেন, “পুলিশে দিলেই হল! তুমি পাষণ্ড আছ বাপু। এই একরত্তি একটা চোরকে কেউ পুলিশে দেয়?”
“চোরের আবার ছোট-বড় কী? সাইজ যাই হোক, চোর তো!”
“মোটেই না! এইটুকু একরত্তি চোরটা পুলিশের হাতে মার খেলে বাঁচবে নাকি? পুলিশগুলোর যা গোদা গোদা চেহারা! না বাপু, তোমার মায়া-দয়া না থাক, আমার আছে।”
মন্টুরামবাবু ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “কী মুশকিল। চোর ছ্যাচড়কে প্রশ্রয় দিলে যে দেশটা অরাজকতায় ভরে যাবে! একরত্তি দেখতে বটে, কিন্তু সাংঘাতিক লোক, সারা রাত আলমারির মধ্যে ঘাপটি মেরে ছিল।”
হরিমতীর চোখ ছলছল করে উঠল, “আহা রে, তবে তো বাছার খুবই কষ্ট গিয়েছে। খিদে-তেষ্টায় মুখ শুকিয়ে একেবারে হস্তুকি। এসো তো বাছা, পেট ভরে ভাত খেয়ে যাও। চোর বলে কি আর মানুষ নয়।”
এই বলে হরিমতী সুধীরের নড়া ধরে টেনে নিয়ে চলে গেলেন।
মন্টুরামবাবু অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করতে করতে বলতে লাগলেন, “কী মুশকিল! কী মুশকিল! এরকম চলতে থাকলে চোর-ডাকাতরা কি আর বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইবে? এ বাড়িতেই থাবা গেড়ে বসে থাকবে যে!”
ঘরের মধ্যে নীরবেই দ্রুত পায়চারি করছিলেন মন্টুরাম। খুব চিন্তিত, কপালে ভাঁজ।
ঠিক এই সময় শুনতে পেলেন, কে যেন বলে উঠল, “মন্টুরাম!”
মন্টুরাম চমকালেন না, কারণ গলাটা তিনি বিলক্ষণ চেনেন। এ
হল দু’নম্বর মন্টুরামের গলা। দু’নম্বর মন্টুরামের সবচেয়ে বড় দোষ হল, সে প্রায়ই মন্টুরামকে উপদেশ দেওয়ার জন্য হাজির হয়।
মন্টুরাম অত্যন্ত তিক্ত গলায় খ্যাক করে উঠলেন, “কী চাই?”
“কাজটা তুমি ঠিক করোনি মন্টুরাম।”
“কোন কাজটা?”
“মদন তপাদারের বাক্সটা হাতিয়ে নেওয়াটা তোমার ঠিক হয়নি।”
“ঠিক হয়নি মানে? মদন তপাদার যে আমার নতুন সাইকেল, পিতলের ঘড়া, দেওয়ালঘড়ি আর এক পাঁজা বাসন চুরি করেছিল!”
“মন্টুরাম, তুমি ভালই জানো, ওসব মোটেই মদন তপাদার চুরি করেনি।”
“তবে কে করেছিল?”
“তা কে জানে! যে-ই করুক, মদন তপাদার নয়।”
“তাকেই সবাই সন্দেহ করেছিল। তার ভাগ্য ভাল যে, আমরা তাকে পুলিশে দিইনি।”