“মহারাজ, এবার যে আমাকে বিদায় নিতে হবে।”
হরিশ্চন্দ্র বিস্মিত হয়ে বলেন, “সে কী! এই তো সেদিন কাজে ঢুকলে! এখনও পয়লা মাসের বেতন পাওনি?”
হিরু হেসে বলে, “আপনার কাছ থেকে বেতনের চেয়েও অনেক বেশি কিছু পেয়েছি।”
হরিশ্চন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা যাবেটা কোথায়?”
“আমি অনেক দূরে একটা গাঁয়ের স্কুলে ইংরিজি পড়াই। সেখানেই ফিরে যাব।”
হরিশ্চন্দ্র ভ্রু তুলে বললেন, “ইংরিজি পড়াও! বাঃ বাঃ বেশ।”
“একটা কথা মহারাজ। আপনার পিসিমাদের আয়না কেড়ে নেওয়ায় তারা খুব দুঃখ পেয়েছেন বলে শুনেছি।”
“সে আর বোলো না। শাপশাপান্ত করে শেষ করছেন।”
“তাদের এই আয়নাটা দয়া করে দিয়ে দেবেন।”
হরিশ্চন্দ্ৰ আঁতকে উঠে বললেন, “আবার আয়নার ফেরে ফেলতে চাইছ নাকি বাপু?”
“ভয় নেই মহারাজ, এটা কেউ ফেরত চাইবে না। তা হলে আমি মহারাজ যাই।”
“এসো গিয়ে।”
হিরু তপাদার প্রণাম করে চলে গেল। হরিশ্চন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার গমনপথের দিকে চেয়ে রইলেন। বাড়িটা একটু ফাঁকা লাগবে কি? তা ফাঁকা লাগার অভ্যেস তার আছে।
মাঝরাতে তিন পিসি আয়না পেয়ে এমন কোলাহল করে উঠল যে, হরিশ্চন্দ্রকে নিজের কানে হাতচাপা দিতে হল। কানা পিসি খলখল করে হেসে বলে, “ও হরি, দিলি নাকি আয়নাটা! দিলি?”
কুঁজো পিসি ফোকলা হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ে আর কী, বলে, “ও হরি, আর কেড়ে নিবি না তো বাবা? একেবারে দিলি তো?”
খোঁড়া পিসি চোখের জল মুছে ধরা গলায় বলে, “হরি রে, তুই যে আমাদের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলি বাপ!”
কানা পিসি আয়নায় মুখ দেখে সে কী খুশি! বলে, “ওরে, দ্যাখ দ্যাখ, আমার বয়স যেন কয়েক বছর কমে গিয়েছে! মুখের কোঁচকানো ভাবটা যেন অনেক কম!”
“দেখি দেখি,” বলে কুঁজো পিসি আয়নায় মুখ গুঁজে বলে, “ওমা! তাই তো দিদি, আমার গালেও যেন একটু রাঙা রাঙা ভাব। শরীরটা কি একটু ফিরল তা হলে?”
খোঁড়া পিসি হামলে পড়ে বলল, “আ মোলো যা, আমাকেও একটু দেখতে দিবি তো। ওরেব্বাস রে, আমার চোখের কোলে কালিটা আর নেই তো! রংটাও যেন খুলেছে!”
হরিশ্চন্দ্র তিন পিসির কাণ্ড দেখে ভারী তৃপ্তি বোধ করছিলেন। কানা পিসি ঝনাৎ করে একটা থলি হরিশ্চন্দ্রের বিছানায় ফেলে দিয়ে বলল, “নে বাবা, ওতে এক হাজার ভরি গিনি আছে। প্রাসাদের পাঁচিলটা ভাল করে সারিয়ে ফেল তো। আর সিংহদরজায় ফটক লাগাস বাবা। বড্ড ভয়ে ভয়ে থাকি।”
খোঁড়া পিসি বলে, “হ্যাঁ বাবা হরি, ফটকে একজন শক্তপোক্ত দরোয়ানও মোতায়েন করিস, তার মাইনে আমরা মাসে মাসে তোকে দিয়ে দেব। দেখিস বাবা, নাদু মালাকার যেন এ বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢুকতে না পারে।”
কুঁজো পিসি বলে, “শেষ বয়সে একটু শান্তিতে থাকতে দিস বাবা। তোর হাজার বছর পরমায়ু হবে।”
কোলাহল করতে করতে পিসিরা উধাও হল।
মাঝেমধ্যে ট্রাপিজের খেলোয়াড়টিও হাজির হয়। এক ঝাড়বাতি থেকে আর এক ঝাড়বাতিতে ঝুল খেতে খেতে বলে,
“আমার ছেলেকে আপনার কেমন লাগল মহারাজ?”
হরিশ্চন্দ্র প্রাণ হাতে করে ওই বিপজ্জনক লাফঝাঁপ দেখতে দেখতে বলেন, “তোমার ছেলে ঠিক তোমার মতোই হয়েছে হে তপাদার। তবে তোমার মতো প্রাণঘাতী লাফঝাঁপ করে বেড়ায় না।”
মদন তপাদার হাসতে হাসতে বলে, “আমি গরিব ছিলুম বটে মহারাজ, কিন্তু তোক ভাল ছিলুম।”
.
কালোবাবু ওরফে বাঁকা মহারাজ ওরফে খগেন নন্দী এখন পুলিশের হেফাজতে। সোনাদানা সব মন্টুবাবু ফেরত পেয়ে গিয়েছেন। সুধীর গায়েন বটতলায় তেলেভাজার দোকান খুলেছে এবং তার ব্যাবসা রমরম করে চলছে।
রাজবাড়ির পাঁচিল মজবুত করে সারানো হয়েছে, সিংহদরজায় লাগানো হয়েছে নতুন লোহার ফটক। একজন গোঁফ-চোমড়ানো তাগড়াই দরোয়ান দিনরাত পাহারা দিচ্ছে। এই দেখে নাদু মালাকার কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে সেই যে ফিরে গিয়েছে, আর আসেনি।
হরিশ্চন্দ্র একজাড়া নরম বিদ্যাসাগরী চটি কিনেছেন, নতুন জরির একটা পোশাকও হয়েছে তার। আর আমসত্ত্ব দিয়ে দুধও খাচ্ছেন দু’বেলা। সঙ্গে নতুন আলু দিয়ে কচি ফুলকপির ঝোল।
মাঝে-মাঝে হরিশ্চন্দ্রের মনে হয়, না, তিনি সবটাই ভুল দ্যাখেন না, সবটাই ভুল শোনেন না, সবটাই ভুল বোঝেন না এবং সবটাই ভুল বলেনও না।