.
“বুরুচ, আমাকে চিনতে পারছ?”
“আমার অভিবাদন নাও হিরু তপাদার। তুমি বড় হয়ে গিয়েছ।”
“হ্যাঁ বুরুচ, আমি আর ছোট্ট খোকাটি নেই।”
“তাই দেখছি হিরু তপাদার। তোমার চোখে বুদ্ধির উজ্জ্বলতা। তোমার নির্ভীক মুখশ্রী। তুমি একজন ভাল মানুষ।”
“আমাকে এখন কী করতে হবে বুরুচ, তুমি বলে দাও।”
“মধ্যরাতে নীল আকাশ থেকে একটা বিদ্যুতের শিখা মাটিতে নেমে আসবে। চারদিক আলোয় আলোময় হয়ে যাবে। ভোর হয়েছে ভেবে পাখিরা ডাকাডাকি করে আকাশে উড়তে থাকবে। তোমাদের মন্দিরে যেমন ঘণ্টা বাজে, তেমনি এক ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাবে তুমি। কুয়াশা উঠে আসবে ঘাস থেকে, কুয়াশা নেমে আসবে আকাশ থেকে, এক মায়া আবরণে ঢেকে যাবে চারদিক। তখন আলোর ঘেরাটোপ থেকে আমাদের যোদ্ধারা বেরিয়ে আসবে।”
“তারা কি ভয়ংকর বুরুচ?”
“তারা ভয়ংকর। কিন্তু তোমার কাছে নয়। তারা জানে হিরু তপাদার একজন বন্ধুর নাম। হিরু তপাদার শত্রু নয়।”
দু’দিন পর এক মধ্যরাতে হিরুর গলার লকেটে একটা মৃদু কম্পন শুরু হল। ঘুম ভেঙে উঠে বসল হিরু। তবে কি সময় হয়েছে? হিরু কান পেতে শুনতে পেল, বহু দুর থেকে একটা বিষণ্ণ ঘণ্টার ধ্বনি ভেসে আসছে। হিরু উঠে পড়ল। রাজবাড়ির সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মেঘহীন পরিষ্কার আকাশে আঙুরের থোকার মতো রাশি রাশি তারা ঝুলে আছে। চরাচর স্তব্ধ হয়ে আছে। ঝিঁঝিপোকারও শব্দ নেই। শুধু ঘণ্টা বাজছে দুরে।
হঠাৎ আলোর বল্লমের মতো এক তীব্র বিদ্যুৎশিখা অন্ধকার চিরে চোখ ধাঁধিয়ে নেমে এল নীচে। আর ঘাস থেকে, মাটি থেকে, আকাশ থেকে পুঞ্জ-পুঞ্জ কুয়াশা পাকিয়ে উঠতে লাগল চারদিকে। লাল, নীল, হলুদ, কমলা, সবুজ। চারদিক এক রামধনু-কুয়াশায় ঢেকে গেল। চারদিকে পাখিদের ওড়াউড়ির শব্দ পাচ্ছে সে, ভোর ভেবে ডাকাডাকি করছে পাখিরা। বাগানে ভাঙা ফোয়ারার পাশে আলোর স্তম্ভটি স্থির হয়ে আছে।
আলোর আবরণ থেকে একে একে দশজন যোদ্ধা বেরিয়ে এল। বিশাল ধাতব শরীর ঝকঝক করছে। তারা এসে সিঁড়ির নীচে হিরুর মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপর নতজানু হয়ে সকলে একসঙ্গে এক সুরেলা গলায় বলে উঠল, “আমাদের অভিবাদন হিরু তপাদার।”
হিরু জোড়হাতে বলল, “আমি সামান্য এক মানুষ। এই নাও তোমাদের জিনিস ফিরিয়ে দিলাম।”
সামনের অগ্রবর্তী যোদ্ধা তার ধাতব হাত বাড়িয়ে আয়না আর লকেটটা নিয়ে একটা ছোট বাক্স হিরুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তোমার জন্য উপহার হিরু তপাদার। দয়া করে গ্রহণ করো।”
যোদ্ধারা উঠে দাঁড়াল, একটু একটু করে পিছিয়ে আলোর স্তম্ভের মধ্যে মিলিয়ে গেল। তারপর হঠাৎ দপ করে নিভে গেল আলো।
গোটা ঘটনাই যেন স্বপ্ন-স্বপ্ন লাগছিল হিরুর। এরা কারা? এরা কেমন মানুষ? সম্মোহিতের মতো নিজের ঘরখানায় ফিরে এসে সে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর হাতের বাক্সটা খুলল। তারপর অবাক হয়ে দ্যাখে, বাক্সের মধ্যে অবিকল একই রকম আর একটা আয়না!
ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ আয়নাটার দিকে চেয়ে থেকে ঢাকনাটা খুলতেই একজন অত্যন্ত সুন্দরী যুবতী চমৎকার হেসে বলে, “সুপ্রভাত হিরু তপাদার। এই জাদু-আয়না তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছে। প্রথম কথা, এই আয়নাকে শুধু একটা আয়না হিসেবে ব্যবহার করতে পারো। শুধু আয়না কথাটা উচ্চারণ করলেই এটা সাধারণ আয়না হয়ে যাবে। আর যদি অন্য কোনও জিনিসের সন্ধান চাও, তা হলে আয়না তারও সন্ধান দেবে। তুমি কি গুপ্তধন চাও? তা হলে একবার বলো, গুপ্তধন।”
বিস্মিত হিরু একটু হেসে বলল, “গুপ্তধন।” সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার ছবি অদৃশ্য হল। তার বদলে ফুটে উঠল একটা আলোকিত গহ্বরের ছবি। নেপথ্যে সেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর বলতে লাগল, “এই যে দেখছ, এটি হল রাজবাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণের স্তম্ভটি। ওর ভিতরটা ফাঁপা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। কয়েকটা ইট সরালেই গহ্বরের সন্ধান পাবে। পনেরো ফুট নীচে ওই দ্যাখো বাক্সভরতি সোনার টাকা, সোনার তৈরি বাসন, সোনার কত গয়না!”
বাস্তবিকই আয়নায় বাক্সগুলো দেখা যাচ্ছে। তারপর ছবি বদলে গেল।
মেয়েটির গলা বলতে লাগল, “এবার বাগানের পিছন দিকে ভাঙা শিবের মন্দিরটা দ্যাখো। ওর পিছনের পুরু দেওয়ালটার ভিতরে রয়েছে তিনটি বড় বড় সোনার মূর্তি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। এক-একটা মূর্তির ওজন এক মন করে।”
বাস্তবিকই আয়নায় পাশাপাশি তিনটি মূর্তি দেখা যাচ্ছে।
“এইবার চলো পুকুরের নীচে, জলের তলায়। ওই দ্যাখো, ঠিক মাঝখানে একটা শ্বেত পাথরের চাঙড় পড়ে আছে। ওটা সরালে …।”
শিহরিত এবং স্তম্ভিত হিরু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আয়না! আয়না!”
ছবি মিলিয়ে গেল। কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হল। আয়নায় ফুটে উঠল তার প্রতিবিম্ব। ঢাকনাটা বন্ধ করে বজ্রাহতের মতো বসে রইল হিরু। এ বড় সর্বনেশে জিনিস। গুপ্তধনের অতুল ঐশ্বর্যের অর্থ হল আবার লোভ জেগে ওঠা, হিংস্রতার উত্থান, ষড়যন্ত্র আর গুপ্তহত্যার নতুন গল্প, হানাহানির বীজ বপন। মানুষের ভিতরকার রাক্ষসটাকে জাগিয়ে ভোলা কি ভাল?
ভোরবেলায় সামনের বারান্দায় নরম রোদে পা মেলে দিয়ে হরিশ্চন্দ্র প্রসন্ন মুখে বসে আছেন। শরৎ ঋতু যাই যাই করছে। একটু-একটু করে ঠান্ডা পড়তে লেগেছে। ক’দিন পরেই বাজারে নতুন ফুলকপি আর লাল আলু উঠবে। বড্ড দাম। তবে কয়েকটা গিনি লুকানো আছে। এক-আধদিন ফুলকপি আর আলু খেলে মন্দ হয় না। নতুন আলু আর ফুলকপির চিন্তায় যখন বিভোর হয়ে আছেন, তখন হিরু তপাদার এসে তাঁকে প্রণাম করে পায়ের কাছটিতে বসল।