হরিশ্চন্দ্র বিছানা থেকে আয়নাটা তুলে হিরুর হাতে দিয়ে বললেন, “এসব বিপজ্জনক জিনিস। সাবধানে রেখো বাপু। বেশি নাড়াঘাটা করতে যেয়ো না যেন।”
হিরু বলল, “পায়ের ধুলো দিন রাজামশাই। আপনার মতো মানুষ আমি জীবনে আর একটাও দেখিনি।”
৮. গোবিন্দ ঘোষ মন্টুরামকে হিংসে করে
গোবিন্দ ঘোষ যে মন্টুরামকে হিংসে করে, এটা মন্টুরাম অনেকদিন ধরেই জানেন। লোকে হিংসে করলে অবশ্য মন্টুরাম অখুশি হন না। বরং খুশিই হন। এত যে টাকা-পয়সা রোজগার করছেন, এই যে এত গাড়ি বাড়ি, সম্পত্তি করলেন, এই যে এত সোনাদানা, ঘরে দামি দামি সব জিনিস, এত কাজের লোক, এসব দেখে যদি লোকের হিংসেই না হবে তা হলে এত পরিশ্রমই তো বৃথা। লোকে হিংসে করে বলেই তো সুখ। কিন্তু হিংসে করতে গিয়ে গোবিন্দ ঘোষ যে তার ঘরে চোর ঢোকাবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। গতকালই কানাই দারোগা গোবিন্দ ঘোেষকে পিলে-চমকানো জেরা করেছেন এবং তার ধারণা হয়েছে, এই চুরির সঙ্গে গোবিন্দর একটা সম্পর্ক আছে। তবে গোবিন্দকে গ্রেফতার করা হয়নি এখনও। আরও সাক্ষ্যপ্রমাণ পেলে সেটাও হবে।
ফলে গোবিন্দ ঘোষের বাড়িতে মড়াকান্না উঠেছে। অরন্ধন চলছে। গোবিন্দ ভয়ে কাতর হয়ে শয্যা নিয়েছেন, কাজে বেরোচ্ছেন না। এসব খুবই আহ্বাদের খবর বলেই মন্টুরামের মনে হচ্ছে। বিস্তর সোনাদানা এবং মদন তপাদারের বাক্স চুরি হওয়ায় তার ক্ষতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সমুদ্র থেকে এক মগ জল তুললে কি সমুদ্র তা টের পায়? চুরিটা তাই তাকে বেশি দাগা দিতে পারেনি। বরং গোবিন্দ ঘোষের দুর্দশায় তার ভারী আনন্দ হচ্ছে।
কিন্তু মুশকিল হল, মন্টুরামের দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। একজন তাঁর বউ হরিমতী, অন্যজন দু’ নম্বর মন্টুরাম।
হরিমতী সকাল থেকেই ঘ্যানঘ্যান করছেন, “ওগো, ওরা গরিব মানুষ, ওদের না আছে পয়সার জোর, না আছে ক্ষমতা। চোর ওদের বাড়ি বয়ে এসেছিল, তাতে ওদের দোষ কী বলল! গোবিন্দবাবু ভারী নিরীহ মানুষ, তুমি আর ওদের উপর চাপ দিয়ো না। লোককে ক্ষমাঘেন্না করতে শেখো৷”।
আর দু’নম্বর মন্টুরামের সঙ্গে সকাল থেকেই তার দফায় দফায় ঝগড়া চলছে।
বেলা আড়াইটেয় যখন মন্টুরাম তার অফিসঘরে বসে ব্যাবসার হিসেবপত্র দেখছেন, তখনই দু’নম্বর মন্টুরাম ফের হাজির হয়ে বলল, “মন্টুরাম, নিজেকে তুমি কী ভাবো বলল তো! তোমার টাকা আছে আর প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে বলেই কি তার জোরে তুমি সকলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসতে চাও? তুমি রাজা না উজির?”
“দ্যাখো দু’নম্বর, আমি আইন নিজের হাতে নিইনি। যা করার পুলিশ করছে, আর সেটা আইন মেনে।”
“কাকে ভাঁওতা দিচ্ছ? কানাই দারোগা তোমার অঙ্গুলিহেলনে চলেন, এ সবাই জানে। আইন-আদালত তো তোমার পকেটে! তুমি হলে একজন হৃদয়হীন পাষণ্ড। ভাল চাও তো গিয়ে গোবিন্দ ঘঘাষের কাছে ক্ষমা চেয়ে এসো।”
মন্টুরাম অবাক হয়ে বললেন, “ক্ষমা চাইব কেন? গোবিন্দ ঘোষকে তো আমি অপমান করিনি।”
তার ম্যানেজার উমাপদ এসে পড়ায় ঝগড়াটা আর বেশি দূর চলল না বটে, কিন্তু দু’নম্বর মন্টুরাম ছাড়ার পাত্র নন। এবং মন্টুরাম জানেন, ক্রমে ক্রমে হরিমতী আর দু’ নম্বর মন্টুরাম মিলে তাকে একদিন পেড়ে ফেলবেন। এবং শেষ পর্যন্ত তিনি রণে ভঙ্গ দিয়ে ফেলবেন। আর এই কারণেই মন্টুরামের মনটা আজকাল বেজায় ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে এবং তিনি সারা দিনে অনেক দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ঘণ্টায় অন্তত দশটা-বারোটা তো হবেই।
বিকেলের দিকটায় মন্টুরামের পেটে বায়ু হয়ে উদ্গার উঠতে লাগল। ভারী অসোয়াস্তি। অকারণে ঘামও হচ্ছে। নিজের নাড়ি দেখলেন মন্টুরাম। কিছু বুঝতে পারলেন না।
দু’নম্বর মন্টুরাম প্রম্পটারের মতো আড়াল থেকে বলল, “পেটে বায়ু তো হবেই হে মন্টুরাম, মানুষের অভিশাপও তো আছে। গিয়ে দেখে এসো, গোবিন্দ ঘোষের বাড়িতে আজ কেউ সঁতে দানাটাও কাটেনি। উপোস করে পড়ে আছে। লোকে আঙুল দেখিয়ে বলছে, এরা হল চোরের মাসতুতো ভাই। কী অপমানটাই হচ্ছে ওদের!”
“তা কী করতে হবে?”
“গিয়ে একটু মিষ্টি কথা বলে এলেও তো হয়। তুমি মানী লোক, ওদের বাড়ি গিয়ে দাঁড়ালে ওরা ধন্য বোধ করবে।”
মন্টুরাম খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “তাতে আমার পেটের বায়ু কমবে কি?”
“ওরে বাপু, ওইটেই তো তোমার বায়ুর ওষুধ!”
“আর আমার অত সোনাদানা যে চলে গেল! মদন তপাদারের বাক্সটা হাতছাড়া হল!”
“মন্টুরাম, ওই সোনাদানার নিরানব্বই ভাগই হল বন্ধকি সোনা। চড়া সুদে বন্ধক দিয়ে কয়েকশো লোক আর ছাড়াতে পারেনি। ওই সোনায় দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে। ও গিয়ে বেঁচে গিয়েছ হে। আর মদন তপাদারের বাক্স তো তোমার জিনিস নয়। দুঃখ করছ কেন?”
সন্ধের মুখে মন্টুরাম উঠলেন। দোকান থেকে এক হাঁড়ি ক্ষীরকদম্ব কিনে গুটিগুটি গোবিন্দ ঘোষের বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়লেন।
দরজা খুলে গোবিন্দ হাঁ, “মন্টুরাম! তুমি?”
“মাফ করে দিয়ো ভাই। সকালে তোমার বড্ড হেনস্থা হয়েছে, ওসব মনে রেখো না। কাল আমার ছোট মেয়ের জন্মদিন, তোমাদের সকলের নেমন্তন্ন রইল।”
গোবিন্দ ঘোষ হাউহাউ করে কেঁদে মন্টুরামকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর চোখের জল মুছে বললেন, “এসো ভাই, গরিবের বাড়িতে অন্তত এক কাপ চা খেয়ে যাও।”
মন্টুরাম অনুভব করলেন, তার পেটের বায়ু নেমে গিয়েছে। আর এটা তার চা খাওয়ারই সময়। তাই বললেন, “তা মন্দ কী! আজ বিকেলের চা-টা বরং তোমার সঙ্গেই হয়ে যাক।”