“চালাকি করবেন না, ঠুকে দেব। কথা না বাড়িয়ে আয়নাটা দিয়ে দিন। আমি জানি, মদন তপাদারের আয়না আপনার কাছে আছে।”
ঠিক এই সময় কানা, খোঁড়া আর কুঁজো পিসি বেশ হেলেদুলে হাসি হাসি মুখ করে ঢুকে দিব্যি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেল।
কানা পিসি আহ্লাদের গলায়ই বলে, “দেখলি তো হরি, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে কি না! একটা নিঘিন্নে চোরকে আমাদের সাধের আয়নাটা চুরি করতে লাগালি! তোর পাপের ভয় নেই?
কি শাপশাপান্ত গেরাহ্যি করিস না? এখন এই মিনসে যদি তোর বুকে গুলি ঠুসে দেয়, তা হলে তো তোর পাপেরই শাস্তি হবে নাকি?”
খোঁড়া পিসি বলে, “ওরে, তোর পিসিরা কি ভেসে এসেছে? তাদের একটু সাধআহ্লাদ থাকতে নেই? রুজ পাউডার মাখছি না, পমেটম ঘষছি না, শুধু মাঝেমধ্যে আয়নায় একটু মুখ দেখা! বলি, তাও তোর সইল না?”
কুঁজো পিসি ফঁৎ করে একটা শাস ছেড়ে বলে, “এই যে তোকে সোনাদানা বের করে দিচ্ছি, ভালমন্দ খেতে বলছি, তোর খোঁজখবর রাখছি, বাবা-বাছা বলছি, এর কি কোনও দাম নেই রে হরি? বলি রক্তের সম্পর্কটাও কি মানতে নেই? এই মড়াখেকো গুন্ডাটার হাতে যদি মরিস, তা হলে তোর গতি কী হবে বল তো?”
লোকটা তার কপালে পিস্তলের নলের একটা জোর খোঁচা দিয়ে বলল, “এই যে রাজামশাই, শুনতে পাচ্ছেন?”
হরিশ্চন্দ্ৰ ককিয়ে উঠে বললেন, “শুনেছি বাপু, শুনেছি। একটু রোসো। বুড়ো বয়সে নড়াচড়া করতেও তো সময় লাগে বাপু। হাড়ের জোড়ে জোড়ে ব্যথা, আধিব্যাধিরও কি শেষ আছে?”
“আমার হাতে বেশি সময় নেই। তাড়াতাড়ি করুন।”
কানা পিসি বলল, “দে না বন্দুকের ঘোড়াটা টিপে। বুঝুক মজা।”
খোঁড়া পিসি বলে, “মিনসেটা যেন কী! ম্যাদামারা।”
কুঁজো পিসি বলল, “আজকালকার গুন্ডাগুলোও তেমনি। হাঁদাগঙ্গারাম।”
হরিশ্চন্দ্ৰ কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠতে গিয়েই অম্বুরি তামাকের গন্ধটা পেলেন। দেখলেন মহিমচন্দ্র চেয়ারে বসা। রক্তচক্ষুতে লোকটার দিকে চেয়ে বাঘা গর্জনে বললেন, “বেয়াদবটা কে রে হরি?”
হরিশ্চন্দ্র মিনমিন করে বলেন, “তা কি আর চিনি?”
“ধরে দুটো রদ্দা দে না। তোকে যে ছেলেবেলায় মাইনে করা কুস্তিগির রেখে কুস্তি শিখিয়েছিলুম, তা কি ভুলে গেলি?”
ঠিক এই সময় আরও এক লম্বা চওড়া রাজকীয় পুরুষ ঘরে ঢুকে ভ্রু কুঁচকে বললেন, “এত আস্পর্ধা! আমার বংশধরের গায়ে হাত! ওরে ও হরি, ওটা তিনশো বছরের পুরনো খাট। ওর বাজুতে অস্ত্র লুকোনো আছে। উপরের পিতলের লোহার বলটা এক প্যাঁচ ঘুরিয়ে টেনে তুললেই অস্ত্র বেরোবে।”
হরিশ্চন্দ্র চিনলেন। ইনি তাঁর এক পূর্বপুরুষ প্রতাপচন্দ্র, এঁর ছবি দরবারে ঝোলানো আছে।
হরিশ্চন্দ্র বাজুর পিতলের বলটা আঁকড়ে ধরে উঠলেন এবং উঠবার সময় সেটাতে পাঁচটাও মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে বলটা খট শব্দ করে একটু আলগা হয়ে গেল বলে টের পেলেন হরিশ্চন্দ্র। দাঁড়িয়েই লহমাও দেরি না করে টান দিতেই একটা লম্বা দোধার তরোয়াল লকলক করে উঠে এল হাতে।
এখনও যে তাঁর এত তৎপরতা আছে, তা জানাই ছিল না হরিশ্চন্দ্রের, আর লোকটাও বোধহয় হঠাৎ একটা তরোয়ালের আবির্ভাব দেখে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল। সে নড়বারও সময় পেল না, হরিশ্চন্দ্রের চালানো তরোয়াল বিদ্যুতের মতো ৯৮
বেগে গিয়ে লোকটার কবজিতে বসে গেল। পিস্তলটা ছিটকে গেল হাত থেকে, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। লোকটা ‘বাপ রে’ বলে একটা আর্তনাদ করে কবজি চেপে ধরে মেঝেয় বসে পড়ল।
প্রতাপচন্দ্র হুকুম দিলেন, “গলাটা কেটে ফেল! ফেল কেটে!”
হরিশ্চন্দ্র ততটা করলেন না। তবে ঘরের কোণ থেকে তাঁর মোটা লাঠিটা এনে লোকটার মাথায় জোর এক ঘা বসিয়ে দিলেন। লোকটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
হরিশ্চন্দ্র এবার তাঁর পিসিমাদের দিকে চেয়ে রোষকষায়িত লোচনে বললেন, “পিসি হয়ে ভাইপোর সঙ্গে এরকম ব্যবহার! দাঁড়াও, কালই নাদু মালাকারকে ডাকিয়ে আনাচ্ছি।”
তিন পিসি ভারী জড়সড় হয়ে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। কানা পিসি শুকনো মুখে বলল, “তা আর করতে হবে
বাছা, তোর জিনিস দিয়ে দিচ্ছি।” বলেই পিসিরা উধাও হল বটে, কিন্তু একটু পরেই হরিশ্চন্দ্রের বিছানার উপর আয়নাটা এসে ঠুক করে পড়ল।
ডাকাডাকিতে রাখহরি এল, মোক্ষদা এল, নগেন এল। তার পিছু পিছু এল হিরু তপাদার আর সুধীর গায়েন। সকলেরই চক্ষু চড়কগাছ, “মহারাজ, করেছেন কী? একা হাতে এরকম একটা গুন্ডাকে ঘায়েল করেছেন?”
হরিশ্চন্দ্র বললেন, “ওরে বাপু, রাজার রক্তটা তো এখনও শরীরে আছে, না কি?”
কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা লোকটার দিকে চেয়েই সুধীর চেঁচিয়ে উঠল, “এ তো কালোবাবু!”
হিরু বলল, “শুধু কালোবাবুই নন, এঁর আরও একটা পরিচয় আছে। সেটা ঘোমটা সরালেই বোঝা যাবে।”
ঘোমটা সরাতেই কালো দাড়ি-গোঁফে আচ্ছন্ন একটা মুখ বেরিয়ে পড়ল। আর তাই দেখে সুধীর ডুকরে উঠল, “এ যে বাঁকা মহারাজ!”
হিরু বলে, “এঁর তিন নম্বর পরিচয় হল, নাম খগেন নন্দী, আমার বাবার কাছে ছোঁকরা বয়সে ম্যাজিক শিখতে আসত। সম্ভবত তখনই আয়নার কথাটা জেনে যায়। মহারাজ, বলেছিলুম কি না আয়নার খোঁজে এ লোক আসবেই এখানে। ওই দেখুন ওর গলায় ধুকধুকিটাও রয়েছে। কিন্তু আপনার পিসিমারা তো আয়নাটা হাতছাড়া করতে রাজি নয় মহারাজ! তা হলে কী হবে?”