এ কথায় বুড়ো মানুষটার চোখদুটো যেন পটাং করে গোল হয়ে গেল। লোকটা ভারী উত্তেজিত হয়ে বলল, “আয়না মহারাজ। আয়না? ঠিক শুনছি তো?”
“হ্যাঁ মশাই, সামান্য একটা আয়না।”
“সামান্য আয়না মহারাজ? পৃথিবীর কোনও আয়নাকেই আমাদের সামান্য বলে মনে করা উচিত নয় মহারাজ। আয়না খুবই গুরুতর জিনিস।”
হরিশ্চন্দ্র লোকটার দিকে খুব ঠাহর করে চেয়ে বললেন, “মশাই, গলাটা চেনা-চেনা ঠেকছে, কিন্তু মুখটা চেনা লাগছে না তো?”
বুড়ো মানুষটা বলল, “গলা যখন ধরা পড়েছে, মুখও পড়বে মহারাজ।”
এই বলে লোকটা পিছু ফিরে ডাকল, “এসো হে সুধীর।”
থামের আড়াল থেকে একটা বেঁটেখাটো লোক বেরিয়ে এসে হরিশ্চন্দ্রকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। হরিশ্চন্দ্র একটু অবাক হয়ে বললেন, “এ লোকটি কে?”
বুড়ো মানুষটি বলল, “এ একজন চোর, মহারাজ। এর নাম সুধীর গায়েন।”
হরিশ্চন্দ্রের একগাল মাছি। থতমত খেয়ে বললেন, “চোর! ঠিক শুনলাম তো! চোর বললেন নাকি?”
“ঠিকই শুনেছেন। সুধীর একজন বেশ পাকা চোর। চোরদের আপনি খুব একটা অপছন্দ করেন না তো!”
হরিশ্চন্দ্র একটু ভাবিত হয়ে বললেন, “তা চোরই বা খারাপ কী? ঠিকমতো ভেবে দেখলে আগেকার রাজা-জমিদাররাও তো আসলে চোর-ডাকাতই ছিলেন। অন্যের রাজ্য লুঠপাঠ করতেন, রাজকন্যাদের হরণ করতেন। না বাপু, আমি চোরদের তেমন অপছন্দ করি না। আমার ঠাকুরদার তো একজন মাইনে করা চোর ছিল। তার নাম গোপাল গায়েন।”
সুধীর আর একবার হরিশ্চন্দ্রকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলল, “আজ্ঞে, তিনি আমার বাবার শ্রদ্ধেয় ঠাকুরদা।”
হরিশ্চন্দ্র খুশি হয়ে বললেন, “তা হলে তো তুমি বংশানুক্রমিক চোর। চুরি তো তোমার রক্তে হে।”
মলিন মুখে মাথা নেড়ে সুধীর গায়েন বলে, “না মহারাজ, আমাকে কুলাঙ্গার বললেও অত্যুক্তি হয় না, কোনও কাজেই শেষরক্ষা করতে পারি না। এই তো কাল রাতেই মন্টুরাম সিংহের বাড়ি থেকে অনেক কসরত করে মদন তপাদারের বাক্সটা বের করে আনলাম, কিন্তু শেষরক্ষে হল কই? চৌপথীর মোড়ে একটা ষণ্ডা মাথায় ডান্ডা মেরে নিয়ে গেল।”
হরিশ্চন্দ্র একটু আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! সেই লকেটখানাও হাতছাড়া হয়েছে নাকি?”
বুড়ো মানুষটি বলে, “যে আজ্ঞে। তবে কিনা শুধু লকেটে কোনও কাজ হবে না। সঙ্গে আয়নাখানাও চাই। লকেট আর আয়নার সম্পর্ক কেমন জানেন? এই যেমন সজনে ডাঁটার সঙ্গে কুমড়ো, নিমের সঙ্গে বেগুন, পোস্তর সঙ্গে আলু। সুতরাং লকেটওলা আয়নার খোঁজে এল বলে।”
হরিশ্চন্দ্র একটু শঙ্কিত হয়ে বললেন, “সেটা কি ভাল হবে বাপু? সে তো আর লোক ভাল নয়।”
বুড়ো মানুষটি দুঃখের সঙ্গে বলে, “ভাল লোক বড় কমে যাচ্ছে মহারাজ।”
“তা হলে উপায়?”
“উপায় আপনার হাতে মহারাজ। আপনার গুজগুজ আর ফিসফাসদের সঙ্গে একটু কথা কয়ে দেখুন।”
হরিশ্চন্দ্র একটু অবাক হয়ে বলেন, “গুজগুজ আর ফিসফাস! ওহে, দাড়িগোঁফের আড়ালে ওটা কি হিরু তপাদার নাকি তুমি?”
“যে আজ্ঞে।”
হিরু তার দাড়ি-গোঁফ, পরচুলা খুলে ফেলে হরিশ্চন্দ্রকে একটা প্রণাম করে বলল, “মহারাজ, সত্যিই কি আয়নার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে?”
হরিশ্চন্দ্র চিন্তিত মুখে বললেন, “গুজগুজ আর ফিসফাস শুনে তাই তো মনে হয়। দেখাই যাক।”
সুধীর ভাঙা সিঁড়িটা একবার দেখে নিয়ে টক করে কয়েকটা ধাপ তড়তড় করে উঠে মস্ত ফাঁকটার কাছে পৌঁছে রেলিং-এর উপর উঠে দিব্যি প্রথম চাতালটায় পৌঁছে গেল। তারপর পরের ধাপগুলো উঠবার মুখেই হঠাৎ ছাদের দিক থেকে শাঁই করে একটা আধলা ইট নেমে এল তার দিকে। ‘বাপ রে’ বলে দু পা পিছিয়ে এল সুধীর।
“মহারাজ, ছাদ থেকে কে যেন ঢিল ছুড়ছে!” মহারাজ উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “বটে!”
সুধীর ডিঙি মেরে ছাদের দিকটা দেখবার চেষ্টা করছিল। অমনি আরও চার-পাঁচটা বড় বড় ঢিল দমাদম এসে পড়তে লাগল সুধীরের আশপাশে। একটা ঢিল তার হাঁটুতেও লাগল।
সুধীর পট করে রেলিং বেয়ে নেমে এসে হাঁটু চেপে বসে পড়ে বলল, “মহারাজ, দেখলেন তো, আমি শেষরক্ষা করতে পারি না। আমার ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার তা আমি জানি। শেষ পর্যন্ত বটতলায় তেলেভাজার দোকান দেওয়া ছাড়া আমার আর গতি নেই।”
হিরু অবাক হয়ে বলে, “কিন্তু ছাদ থেকে ঢিলটা ছুড়ছে কে মহারাজ? ছাদে তো কেউ থাকে না!”
হরিশ্চন্দ্র সখেদে বললেন, “এ বাড়িতে যে কে থাকে আর কে থাকে না, তা আমি আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারলাম না বাপু। তবে আজকের মত রণে ভঙ্গ দাও তোমরা। গুজগুজ আর ফিসফাসকে একটু ঠান্ডা করে না নিলে কাজ আদায় করা শক্ত হবে। তাঁরা বড় রেগে আছেন।”
“যে আজ্ঞে, মহারাজ।” মাঝরাতে ঘুম ভাঙা আর তারপর নানা কিম্ভুত ব্যাপার দেখা হরিশ্চন্দ্রের একরকম অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। সুতরাং তিনি মনে মনে একরকম তৈরিই থাকেন।
কিন্তু আজ রাত দেড়টার সময় যা ঘটল, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। বেশ ফুরফুরে ঘুম হচ্ছিল তাঁর। হঠাৎ মাথায় একটা ঠান্ডা আর শক্ত জিনিস এসে ঠেকল। চটকাটা ভেঙে দ্যাখেন, সামনে কালো কাপড়ে মুখ-মাথা ঢাকা একটা লোক তাঁর মাথায় একটা পিস্তল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হরিশ্চন্দ্রও তো কেঁপে-কেঁপে অস্থির। কোনওক্রমে বললেন, “কে তুমি? কী চাও বাপু?”
“আয়নাটা।”
“আয়না! তা এ বাড়িতে আয়নার অভাব কী? নিয়ে গেলেই হয়।”