“সেই ছেলেটার খোঁজখবর করতে তোমার ইচ্ছে যায়নি?”
মাথা নেড়ে সুধীর বলল, “আজ্ঞে না। খোঁজ নিয়ে কী করব বলুন। আমার নিজেরই পেট চলে না, সেই ছেলের কোন উপকারে আসতে পারতাম? তবে মাঝে মাঝে মনে যে পড়ত না, তা নয়। মদনবাবুর মৃত্যুর জন্য আমিও তো খানিকটা দায়ী।”
“বাপু সুধীর, যা মনে হচ্ছে তোমার বাঁকা মহারাজ আর সহজে এখানে উদয় হবেন না। তিনি অস্তেই গিয়েছেন। চলো যাওয়া যাক।”
.
আজ মধ্যরাতে হরিশ্চন্দ্রের পিসিমাগণের আবির্ভাব ঘটল একটু অন্য স্টাইলে। কানা পিসি ছাদের দিক থেকে বাতাসের অদৃশ্য সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে নামলেন। খোঁড়া পিসি যেন বাতাসের দরজা ঠেলে ঢুকলেন। কুঁজো পিসি যেন সুড়ঙ্গপথ ধরে পাতাল থেকে উঠে এলেন। হরিশ্চন্দ্র একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। তাড়াতাড়ি উঠে বসে বললেন, “পিসিমাগণ, আজ সব ভেন্ন ভেন্ন হয়ে উদয় কেন?”
কানা পিসি বলে, “আর বলিস না বাছা, প্রাণের ভয় কার নেই বল! ওই মুখপোড়া নাদু মালাকার গতকাল সন্ধেবেলা তিনতলার চিলেকোঠায় আমরা যখন চুল আঁচড়াচ্ছি, তখন হাঁড়ি নিয়ে হামলে পড়েছিল। ধরে ফেলে আর কী। কী আস্পর্ধা বল তো! আমরা তো আর হ্যাতা-ন্যাতা মানুষ নই রে বাপু, স্বয়ং রাজাধিরাজের পিসি! শিঙ্গি-মাগুর মাছ তো নই যে, হাঁড়িতে পুরে জিইয়ে রাখবে!”
হরিশ্চন্দ্র উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তা আপনারা কী করলেন পিসিমাগণ?”
খোঁড়া পিসি বলে, “সেই তো বাছা, কী বিপদেই যে পড়েছি। তিনজন বুদ্ধি করে আয়নায় ঢুকে পড়েছিলুম বলে বাঁচোয়া।”
হরিশ্চন্দ্র ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আয়না! আয়নায় কি ঢোকা যায়?”
কুঁজো পিসি বলে, “আয়নায় যে ঢোকা যায়, তা কি আর আমাদেরই জানা ছিল বাপ। কিন্তু দিব্যি ঢুকে গেলুম যে। নাদু কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে চলে গেল।”
“আর আয়নাটা?”
“সে আছে।”
“কীরকম আয়না পিসিমাগণ? আমি যতদূর শুনেছি, আয়নায় ভূত-প্রেতের ছায়া পড়ে না।”
কানা পিসি বলে, “তা ঠিকই শুনেছিস বাপু, এই অবস্থা হওয়ার পর থেকে চেহারার কী ছিরি হয়েছে, তা দেখার জন্য মনটা বড় আঁকুপাঁকু করত। কিন্তু এমনই পোড়া কপাল যে, রাজবাড়ির কোনও আয়নাতেই আমাদের ছায়া পড়ত না। তাই মনে বড় দুঃখ ছিল। তারপর একদিন তোষাখানার তাকে এই আয়নাটা পেলুম। দিব্যি আয়না। দেখলুম, তাতে আমাদের বেশ ছায়া পড়ছে। তা বাপু মুখের ছিরি যাই হোক, দেখতে কার না ইচ্ছে করে বল! এই আয়নাটা হয়ে পর্যন্ত আমাদের একটা দুঃখ তো ঘুচেছে! এখন ওই বজ্জাত নাদু মালাকারের একটা ব্যবস্থা কর বাবা। কবে ধরে তিনজনকেই হাঁড়িতে পোরে, সেই ভয়ে আমরা এখন ভেন্ন ভেন্ন থাকছি।”
হরিশ্চন্দ্র ভাবিত হয়ে বললেন, “হু, খুবই দুশ্চিন্তার কথা পিসিমাগণ। আমি এখন বুড়ো হয়েছি। দৌড়ঝাঁপ করতে পারি না। ঢাল-তলোয়ার তুলতে পারি না। চারদিকে চোখ রাখতে পারি না।”
কুঁজো পিসি ঝংকার দিয়ে বলে, “আ মোলোলা, রাজার ছেলে আবার ওসব কবে করেছে। তোর পাইক-বরকন্দাজ দিয়ে মুখপোড়াটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ঘা কতক দে না। এই নে বাবা, আরও দশখানা গিনি রেখে যাচ্ছি। ভাল-মন্দ খাস।”
সকালে উঠে বিছানায় দশখানা গিনি পেলেন হরিশ্চন্দ্র। পিসিমাদের হাত ক্রমেই দরাজ হচ্ছে। বলতেই হবে যে, নাদু মালাকার বেশ উপকারী লোক। তার কারণেই পিসিমাগণ কৃপণের ধন একটু-একটু করে ছাড়ছেন। বেঁচে থাকো বাবা নাদু মালাকার।
দোতলা থেকে তিনতলার ছাদে ওঠার সিঁড়ি বছর দশেক আগে অনেকটা ভেঙে পড়ে গিয়েছিল। কয়েক ধাপ আছে, আবার কয়েক ধাপ নেই, আবার কয়েক ধাপ আছে, এইরকম আর কী। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার চেষ্টা অতীব বিপজ্জনক। তাই হরিশ্চন্দ্র সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে কী করে তিনতলায় ওঠা যায়, তার উপায় ভাবছিলেন।
এমন সময় পিছন থেকে খুব বিনয়ের সঙ্গে কেউ বলল, “ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সিঁড়ি ভাঙা কি উচিত কাজ হবে মহারাজ?”
গলাটা খুবই চেনা-চেনা লাগল হরিশ্চন্দ্রের। কিন্তু পিছন ফিরে যাকে দেখলেন, তিনি সাদা দাড়ি-গোঁফওলা একজন বুড়ো মানুষ। হরিশ্চন্দ্র চিন্তিত ভাবে লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, “সিঁড়ি ভাঙতে যখন ভাঙা সিঁড়ি ছাড়া অন্য উপায় নেই, তখন সিঁড়ি না ভেঙে আর কী করা যাবে।”
“সেক্ষেত্রে ভাঙা সিঁড়ি যদি আরও ভেঙে পড়ে, তা হলে যে উদ্দেশ্যে সিঁড়ি ভাঙা, তা যে ব্যর্থ হয়ে যাবে রাজামশাই! সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে চাইলেই তো হবে না। সিঁড়ি ভেঙে পড়লে যে উপরে ওঠার বদলে নীচে নেমে আসতে হবে। আর সিঁড়ি ভাঙার সঙ্গে হাত-পা ভাঙাও বিচিত্র নয়।”
হরিশ্চন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সিঁড়ি ভাঙা বেশ বিপজ্জনক কাজ।”
বুড়ো লোকটা বলল, “চিন্তা করবেন না মহারাজ, ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সিঁড়ি ভাঙার লোক হাতেই রয়েছে। সে সিঁড়ি না ভেঙেই সিঁড়ি ভাঙতে পারে।”
“তার মানে কী, সে সিঁড়ি ভাঙবে, কিন্তু সিঁড়িও ভেঙে পড়বে?”
“যে আজ্ঞে। ভাঙা ভাঙা সিঁড়ি দিয়েও সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ওঠা-নামা যায়। তবে তার জন্য ওস্তাদ সিঁড়ি-ভাঙিয়ে চাই। কিন্তু তাকে দিয়ে এই সিঁড়ি ভাঙানোর উদ্দেশ্য কী মহারাজ?”
হরিশ্চন্দ্র আমতা আমতা করে বললেন, “উদ্দেশ্যটা তেমন কিছু নয়। তিনতলার চিলেকোঠায় একটা হাত-আয়না পড়ে আছে, সেটা নামিয়ে আনতে হবে।”