“ওই হল রঘু পালোয়ান।”
“তারপর ডাইনির মতো চেহারার তিনটে ঝগড়ুটে বুড়ি।”
“হেঃ হেঃ, তেনারা আমার তিন পিসি, সর্বদা চতুর্দিকে নজর রাখেন।”
“একজন বিচ্ছিরি রাগী চেহারার সিঁড়িঙ্গে বুড়ো।”
“ঠিক চিনেছ, উনি হলেন আমার শ্রদ্ধেয় খুড়োমশাই। তা বাপু, তোমার বেশ এলেম আছে দেখছি। এত লোককে ফাঁকি দিয়ে এ বাড়িতে ঢোকা তো সোজা কথা নয়।”
“আজ্ঞে, ঢুকতে আমার কালঘাম বেরিয়ে গিয়েছে। তবে কিনা বাঁকাবাবার কাছে গা-ঢাকা দেওয়ার বিদ্যেটা শেখা ছিল বলে রক্ষে। তবে শেষরক্ষে বলেও একটা কথা আছে। সেইটেই যা হল না। আপনার মতো আনাড়ির কাছে ধরা পড়ে যেতে হল।”
“তবেই বোঝো, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে কি না।”
সুধীর ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বলে, “খুব নড়ে কর্তা, খুব নড়ে। আর ওই ধর্মের কলে বাতাস দেওয়ার জন্যই তো আমার আসা কিনা।”
মন্টুরাম একটু থতমত খেয়ে বলেন, “তার মানে? তুমি আবার কোন ধর্মের কলে নাড়া দিতে এলে হে? চোর-ডাকাতদেরও আজকাল ধর্মের নাড়ি টনটনে হয়ে উঠেছে নাকি?”
“তা উঠবে না? চোর-ডাকাতেরও ধর্ম আছে কর্তা। এ লাইনে কি বিপদআপদ কম নাকি? ধর্ম না মানলে চলে?”
“তা বটে। কথাটা ভেবে দেখার মতো। তা বাপু সুধীর, কোন ধর্ম কর্ম করতে এ বাড়িতে ঢুকেছিলে, বলো তো?”
“আজ্ঞে, খিদে পেলে খাওয়াটাও তো ধর্ম, নাকি কর্তা?”
“তা তো বটেই।”
“আমিও ওই পেটের ধর্ম পালন করতেই বিপদ ঘাড়ে করে এই বাড়িতে ঢুকেছিলুম মদন তপাদারের হারানো বাক্সটার খোঁজে। কড়ার ছিল, বাক্সটা উদ্ধার করতে পারলে হাজার পাঁচেক টাকা পাওয়া যাবে।”
মন্টুরাম কিছুক্ষণ হাঁ করে সুধীরের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “কে মদন তপাদার? আর কীসেরই বা বাক্স, এসব আবোল তাবোল হেঁয়ালি বলে পার পাবে ভেবেছ?”
সুধীর হাতজোড় করে বলে, “আজ্ঞে, অপরাধ নেবেন না। এসব আমার কথা নয়। আমাকে যেমন বলা হয়েছিল, তেমনই বলছি।”
“হেঁয়ালি ছেড়ে ঝেড়ে কাশো তো বাপু।”
“কাশছি, কাশছি। শুনেছিলুম যেন, বছর দশেক আগে জাদুকর মদন তপাদার এক সন্ধেবেলায় আপনার বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিলেন।”
“বলি, মদন তপাদারটা কে বটে হে? নামটা জীবনে শুনেছি বলেই তো মনে হচ্ছে না।”
“আজ্ঞে, তিনি ধনপতি বা হুডিনি নন, নিতান্তই গেঁয়ো আর গরিব এক জাদুকর। গাঁয়েগঞ্জে, হাটে-বাজারে ঘুরে-ঘুরে ম্যাজিক দেখাতেন। পসার টসার তেমন ছিল না। হতদরিদ্র অবস্থা। ছেঁড়া পাতলুন, তালি দেওয়া জামা, তাপ্পি মারা জুতো, এই ছিল তাঁর পোশাক। তবে একটা টুপি পরতেন। তার ধারণা ছিল, টুপি পরলে বোধহয় কেষ্টবিষ্ট্রর মতো দেখায়। রোগা, সিঁড়িঙ্গে চেহারার মানুষ, মনে পড়ছে কি কর্তা?”
“না হে বাপু, মনে পড়ছে না। মনে পড়ার কথাও নয়। ওরকম বিটকেল চেহারার কোনও লোককে জীবনে দেখিনি।”
সুধীর উদাস গলায় বলে, “আপনি যদি বলেন তো তাই। তবে কিনা কালোবাবু অন্য কথা বলেন।”
“কালোবাবুটা আবার কে?”
“তা কে জানে কর্তা। চাঁদর মুড়ি দিয়ে ঘোরেন, হাটে-বাজারে দেখা হয়, দাড়ি-গোঁফ আছে, ব্যস, এইটুকু জানি।”
“তা তিনি কী বলেন শুনি!”
“তা তিনি বলেন যে, সেই রাতে আপনি তাকে দাওয়ায় শুতে দেন। তবে তিনি নাকি বাক্সটা আপনাকে দিয়ে বলেছিলেন, “মশাই, এই বাক্সখানায় আমার যথাসর্বস্ব আছে, চুরি হয়ে গেলে পথে বসব। রাতের মতো বাক্সটা আপনার হেফাজতে থাক। মনে পড়ছে কি কর্তা?”
“না হে বাপু, লোকটাকেই মনে পড়ছে না তো বাক্স। তা সেই বাক্সে ছিলটা কী?”
“আজ্ঞে, সে কথা কালোবাবু বলেননি। তিনি শুধু বলেছেন যে, ওই বাক্সটা তাঁর চাই-ই চাই।”
মন্টুবাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “এঃ, মামার বাড়ির আবদার আর কী! মদন তপাদারের বাক্স কি ছেলের হাতের মোয়া যে, চাইলেই পাওয়া যাবে!”
“আজ্ঞে, আমিও তো কালোবাবুকে সেই কথাই বলেছি।”
“কী বলেছ?”
“বলেছি, মন্টুরামবাবু বড় হুঁশিয়ার লোক। বাক্সখানা তাঁর হেফাজত থেকে বের করে আনা ভারী শক্ত কাজ হবে।”
মন্টুরামবাবু আকাশ থেকে পড়ে বললেন, “অ্যাঁ! আমার কাছে বাক্স! ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পাওনি? বাক্স-ফাক্স আমার কাছে নেই। মদন তপাদার নামে কাউকে আমি কস্মিনকালেও চিনি না।”
ঘাড় কাত করে সুধীর ভালমানুষের মতো বলে, “তাই বলে দেবখন।”
“হ্যাঁ, বোলো। আর এ কথাটাও বলে দিয়ো যে, ফের কোনও বেয়াদপি দেখলে তাকে পুলিশে দেব।”
“যে আজ্ঞে। তবে থানা-পুলিশ তো কালোবাবুর জলভাত কিনা। তাঁর নামে সাতটা খুনের মামলা ঝুলছে!”
চোখ বড় বড় করে মন্টুবাবু বলেন, “সাতটা খুনের মামলা! সে তো ডেঞ্জারাস লোক হে!”
“খুব খুব! ডেঞ্জার বলে ডেঞ্জার, তার অ্যাঙ্গারও সাংঘাতিক। অ্যাঙ্গারের উপর অ্যাঙ্গার, কাঁধে বন্দুক, পকেটে পিস্তল, কোমরে ছোরা। খেপে গেলেই রক্তারক্তি। এমন ডেঞ্জার আর অ্যাঙ্গার লোক দুটো দেখিনি মশাই। মদন তপাদারের বাক্স না পেলে আমার গর্দান কি আস্ত থাকবে?”
গলাটা একটু নামিয়ে মন্টুরামবাবু বললেন, “কেন হে বাপু, সেই বাক্সে আছেটা কী? সোনাদানা, হিরে-জহরত তো আর নেই, তিন প্যাকেট তাস, গোটা কয়েক লোহার বল, কয়েকটা চোঙা, একটা খেলনা পিস্তল আর বিটকেল সব হাবিজাবি জিনিস। একজন হাটুরে জাদুকর তো আর বাক্সভরতি মোহর নিয়ে ঘুরে বেড়াত না রে বাপু!”
ঘাড়টা নেড়ে কথাটায় সায় দিয়ে সুধীর বলল, “যে আজ্ঞে, তা হলে কালোবাবুকে গিয়ে তাই বলব যে, আপনি বাক্সখানা ভাল করে নেড়ে-ঘেঁটে দেখেছেন। তাতে তিন প্যাকেট তাস, খেলনা পিস্তল, লোহার বল, চোঙা আর বিটকেল কিছু জিনিস ছাড়া আর কিছু নেই। এই তো! তা বাবু, বাক্সখানা সাবধানে রাখবেন কিন্তু।”