তা দেবতারা গোবিন্দ ঘোষের ডাকাডাকি বোধহয় আজ শুনতে পেলেন। আধঘণ্টা পরে দেখা গেল সুধীর এক হাতে একটা বাক্স আর অন্য হাতে একটা থলি নিয়ে একটু টলমল পায়ে সাঁকো ডিঙিয়ে আসছে।
উত্তেজনার বশে গোবিন্দবাবু একটু জোরেই চেঁচিয়ে ফেলেছিলেন, “জয় মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী!”
তাতে গোটা দুই কাক কা-কা করে উঠল। ভজহরির হাঁক শোনা গেল, “কৌন হ্যায় রে!” একটা সড়ালে কুকুরও যেন সন্দিহান হয়ে বারকয়েক ঘেউঘেউ করে উঠল। গোবিন্দ প্রমাদ গুনলেন। বুক কাঁপছিল। গলা শুকিয়ে আসছিল উত্তেজনায়। চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
মাঝপথে একটু পড়ো পড়ো হয়েছিল সুধীর। কিন্তু সামলে নিল। বাঁশে একটু মচাৎ মচাৎ শব্দ হচ্ছিল যেন। তিরে এসে তরী না ডোবে! গোবিন্দ ঘোষ দাঁতে দাঁত চেপে বাঁশ ধরে রইলেন।
সুধীর হাসিমুখে এই ছাদে এসে লাফ দিয়ে নেমে নিচু হয়ে গোবিন্দর পায়ের ধুলো নিল। গোবিন্দ ঝটিতি বাঁশ দুটো টেনে নিয়ে ছাদের একধারে শুইয়ে রেখে বললেন, “শাবাশ! সব চেঁছে-পুঁছে এনেছ তো?”
সুধীর বলল, “তা মশাই কম হবে না। গিনি আর সোনার বিস্কুটে তিন-চার কেজি তো হবেই।”
গোবিন্দ বললেন, “পাঁচ-সাত কেজি হলে ভাল হত হে।”
“সোনাদানা তো জীবনে খুব বেশি ঘাঁটিনি মশাই। সোনার যে এত ওজন, তা কে জানত!”
“যাক গে বাপু, যা হয়েছে তাই হয়েছে। এবার এসো গিয়ে।”
“আজ্ঞে, আপনার ভাগটা রেখে দিন। আধাআধি বখরা।”
গোবিন্দ ঘোষ আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! ভাগজোখের কথা উঠছে কেন? স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়, পরোধর্ম ভয়াবহ। এর মানে জানো? যার কর্ম তারে সাজে, অন্যের হাতে লাঠি বাজে।”
সুধীর হাঁ করে খানিক চেয়ে থেকে বলে, “এই এত সব আমাকে দিয়ে দিচ্ছেন গোবিন্দবাবু? কিন্তু আপনি যে এত কষ্ট করলেন, মদত দিলেন, এর কি কোনও মজুরি নেই?”
“পাগল নাকি? চোরের ধর্ম আর গেরস্তের ধর্ম আলাদা বাপু।”
“তা হলে আসি আজ্ঞে,” বলে সুধীর তাঁকে প্রণাম করে বিদায় নিল।
গোবিন্দ ঘোষ এসে বিছানায় শুলেন। বুকটা আজ ভারী ঠান্ডা। মনটায় বেশ শান্তি পাচ্ছেন।
সকালবেলায় তাঁর স্ত্রী বাসন্তীদেবী তাঁকে ঠেলে তুললেন, “ওগো, ওঠো! ওঠো! মন্টুরামের বাড়িতে নাকি কাল রাতে মস্ত চুরি হয়ে গিয়েছে?”
গোবিন্দ ঘোষ হাই তুলে ভারী আদুরে গলায় বললেন, “তাই নাকি?”
“হ্যাঁ। মন্টুবাবু দারোগা-পুলিশ নিয়ে ওঁদের ছাদে উঠে আমাদের বাড়ির দিকে আঙুল দিয়ে কী যেন দেখাচ্ছেন!”
আঁতকে উঠে গোবিন্দ বললেন, “আমাদের বাড়ির দিকে? আমাদের বাড়ির দিকে দেখাচ্ছে কেন?”
“তার আমি কী জানি। একটু আগে মন্টুরামের বাঘা কুকুরগুলো এসে আমাদের বারান্দা-দরজা সব শুকছিল। তাদের কী রাগ, যেন ছিঁড়ে খায় আমাদের। ভাগ্যিস শিকলে বেঁধে এনেছিল।”
গোবিন্দ ঘোষ কাহিল গলায় বলেন, “কুকুর কোন সাহসে আমার বাড়ি শুকতে আসে?”
“এই তো পটলা ও বাড়ি থেকে ঘুরে এসে বলল, কানাই দারোগা নাকি আমাদের বাড়িতেও আসবে।”
গোবিন্দ ঘোষ টপ করে উঠে বললেন, “থলিটা দাও, বাজার সেরে আসি।”
বাসন্তীদেবী বললেন, “ওমা! কালই তো বাজার করেছ! আজ আবার বাজার কীসের?”
৭. জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ
বলতে গেলে এটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ। এত সোনা সে জীবনে দ্যাখেনি। তার উপর মদন তপাদারের বাক্সখানা। এটা থেকেও কিছু আয় হবে। সে এখন কত লাখ টাকার মালিক তা বুঝে উঠতে পারছিল না সুধীর গায়েন। এত টাকা নিয়ে কী করতে হয়, তাও সে জানে না। তবে টাকা হলে শিখে নিতে দেরি হবে না। তার ইচ্ছে গরিব-দুঃখীকেও কিছু দেবে। তবে একটা আহাম্মকির কাজ হয়েছে। মন্টুরামের বাড়িতে ধরা পড়ে সে কবুল করে ফেলেছিল যে, মদন তপাদারের বাক্স চুরি করতেই সে ও বাড়িতে ঢুকেছে। সুতরাং এখন পুলিশ হন্যে হয়ে তাকে খুঁজবে। অতএব আজ রাতেই তাকে এই গাঁয়ের সীমানা পেরিয়ে অনেকটা তফাত হতে হবে।
সুধীর একটু তাড়াতাড়িই হাঁটছিল। মনে আনন্দ, শিহরন, উত্তেজনা। চারদিকটা সে যেন ভাল করে খেয়াল করতে পারছে না।
চৌপথীর ঠিক মাঝখানে মন্টুরামের দাদু স্বাধীনতা সংগ্রামী জয়রাম সিংহের একটা প্রমাণ সাইজের ব্রোঞ্জমূর্তি। শ্বেতপাথরের বেদির উপর দাঁড় করানো। সেই মূর্তিটা যখন পেরিয়ে যাচ্ছিল সুধীর, সেই সময়ে একটা খুব সূক্ষ্ম নড়াচড়া টের পেল সে। কিন্তু সতর্ক হওয়ার আগেই কালো মূর্তিটাই যেন লাফিয়ে নেমে এল তার সামনে। কালো কাপড়ে ঢাকা মুখ, লম্বা আর চওড়া মূর্তিটা
ভাল করে ঠাহর করার আগেই তার মাথায় কঠিন একটা জিনিস এসে লাগল। কিছু বুঝে ওঠার সময় পেল না সে। চোখ অন্ধকার হয়ে গেল, মাথাটা ভোঁ হয়ে গেল, সে অজ্ঞান হয়ে গড়িয়ে পড়ল রাস্তায়।
যখন জ্ঞান ফিরল, তখনও আলো ফোটেনি। সুধীর মাথাটা চেপে ধরে উঠে বসে খানিকক্ষণ তার কী হয়েছে বুঝবার চেষ্টা করল। কপালের ডান দিকে একটা টিপলি আঙুলে টের পেল সে, আর অসহ্য যন্ত্রণা। একটু-একটু করে ঘটনাটা মনে পড়ল তার। ব্রোঞ্জমূর্তি তার উপর যে লাফিয়ে পড়েনি, তাও বুঝতে পারল সে। মূর্তির সঙ্গে মিশ খেয়ে যে গা ঢাকা দিয়েছিল, তাকেও সে বোধহয় বিলক্ষণ চেনে। কালোবাবু যে ভয়ংকর লোক, তাও তার অজানা ছিল না। কিন্তু লোকটা যে এত ধুরন্ধর তা আন্দাজ করতে পারেনি।