সুধীর কথাটা একরকম স্বীকার করে নিয়ে বলল, “তা তো ঠিকই গোবিন্দবাবু।”
“তুমি কি আমাকে চেনো নাকি হে?”
“গাঁয়ের সবাইকেই চিনি। না চিনলে আমাদের কাজকারবার চলবে কী করে?”
“অতি সত্যি কথা, অতি সত্যি কথা।”
“মন্টুরাম সিংহের পাশের বাড়িটাই তো আপনার। ছাদের দরজার ছিটকিনিটা একটু আলগা আছে। টয়লেটের জানালার গ্রিল একটু নড়বড়ে, তিনটে স্কু নেই। দরদালানের দেওয়ালে নোনা ধরেছে। আপনার সোনাদানা ব্যাঙ্কের লকারে।”
আহ্লাদে গোবিন্দ ঘোষের চোখে প্রায় জল এসে গেল। গদগদ কণ্ঠে বললেন, “এই না হলে গুণী মানুষ! আহা, বড় আনন্দ হচ্ছে। আজ। এই নাও সুধীর, এই একশোটা টাকা রাখো। আজ একটু ভাল-মন্দ খেয়ো। এটাকে বকশিশ বলে ভেবো না কিন্তু, বলতে পারো গুণীর নজরানা।”
সুধীর টাকাটা পকেটস্থ করে বলে, “তা গোবিন্দবাবু কথাটা কী?”
গোবিন্দ ঘোষ গলাটা নামিয়ে বললেন, “দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার। বুঝলে কিছু?”
“বেশ গা গরম করা কবিতা মশাই!”
“তাই তো বলছি ভাল করে একটু তেতে ওঠো তো বাপু। হাল ছেড়ে দিলে তো হবে না। হাল বেশ সাপটে ধরতে হবে।”
“মশাই, আপনি কি মন্টুরামের বাড়িতে ফের ঢুকতে বলছেন? তাতে লাভ কী? আমি যে জিনিসটা খুঁজতে প্রাণ হাতে করে ও বাড়িতে ঢুকেছিলাম, তা কোথায় রাখা আছে, তা না জানলে সুবিধে হবে না। অত বড় বাড়ি, অত ঘর, বিস্তর আলমারি, বাক্সপ্যাঁটরা। মেহনতে পোষাবে না যে!”
গোবিন্দ ঘোষ গম্ভীর হয়ে বললেন, “দ্যাখো বাপু, ও বাড়ির অন্ধিসন্ধি আমার মুখস্থ। গত ত্রিশ বছর ধরে নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে দিনে-রাতে আমি মন্টুরামের উপর নজর রাখি। তার কোন জিনিসটা কোথায় রাখা আছে তা আমার নখদর্পণে। একবার উচ্চারণ করেই দ্যাখো৷”।
সুধীর ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলল, “সেটা একটা ঘেঁড়াখোঁড়া পুরনো চামড়ার সুটকেস। তাতে দামি জিনিসপত্র নেই বটে, কিন্তু বাক্সটা বড়ই দরকার।”
“ছোঃ, ও একটা জিনিস হল হে বাপু? ও বাড়িতে ঢুকবেই যদি তবে সব চেঁছে-পুঁছে নিয়ে এসো। নইলে যে ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ হবে।”
ভারী লাজুক হেসে হেঁটমুন্ডু হয়ে সুধীর বলে, “তা ঢুকতে পারলে কি আর খালি হাতে বেরোব মশাই? তবে ওই বাক্সখানাও চাই।”
“তার আর চিন্তা কী! যে বাক্সখানার কথা বলছ, সেটা এতকাল মন্টুরামের শোওয়ার ঘরের স্টিলের আলমারির মাথায় অচ্ছেদ্দার সঙ্গে রাখা ছিল। এই দিন কয়েক আগে দেখি সেটাকে মন্টুরাম সরিয়ে নিয়ে ছাদের উপর স্ট্রংরুমের সিন্দুকে রেখেছে। তাতে কোন হিরে-জহরত আছে, কে জানে। কিন্তু রোজই মাঝরাতে উঠে মন্টুরাম বাক্সটা খুলে তাকিয়ে থাকে আর বিড়বিড় করে কথা কয়। একটা পুরনো লজঝড়ে চামড়ার সুটকেস তো?”
সুধীর লাফিয়ে উঠে বলে, “ওইটেই। কিন্তু স্ট্রংরুম তো কঠিন ব্যাপার-স্যাপার মশাই।”
গোবিন্দ ঘোষ বরাভয়ের মুদ্রায় হাত দেখিয়ে বললেন, “ওরে বাপু, লখীন্দরের বাসরেও ছাদা ছিল। বুঝলে? যত বজ্র আঁটুনি, তত ফসকা গেরো। ত্রিশ বছর ধরে মন্টুরামের বাড়িখানা নিয়ে যে গবেষণা করে যাচ্ছি, তা তো আর এমনি নয়। স্ট্রংরুমের দেওয়ালে একখানা একজস্ট ফ্যান লাগানো আছে। ছাদার যা সাইজ, তা দিয়ে অনায়াসে তুমি ঢুকতে পারবে। শুধু একজস্ট ফ্যানটা খুলে ফেলার ওয়াস্তা।”
সুধীর বড় বড় চোখে গোবিন্দ ঘোষের দিকে তাকিয়ে বলে, “মশাই, আপনি তো ইচ্ছে করলেই…?”
গোবিন্দ মৃদু হেসে বললেন, “ওরে বাপু, চোর আর গোয়েন্দায় তফাত কিছুই নেই। শুধু প্রয়োগ আলাদা।”
সুধীর একটু দোনোমোনা করে বলে, “আমি ধরা পড়ার পর মন্টুবাবু বাড়িতে পাহারা বাড়িয়েছেন। এখন ঢোকা আর একটু কঠিন হবে।”
গোবিন্দবাবু চাপা গলায় বললেন, “তা হলে আর আমি আছি কী করতে? পাহারা সব নীচে। তা ছাড়া পিছন দিকটা, যেদিকে আমার বাড়ি, সেদিকটায় পাঁচিলে মন্টুরাম চোরের ভয়ে শূল বসিয়েছে, নীচের বাগানে ফণীমনসা, বিছুটি আর নানারকম কাঁটাগাছ লাগিয়েছে, যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। ফলে ওদিকটায় পাহারা থাকে না। আমার তিনতলার ছাদ থেকে মন্টুরামের ছাদ মাত্র দশ ফুট তফাত। বুঝলে? দু’খানা লম্বা বাঁশ পাশাপাশি ফেললে একেবারে হাওড়ার ব্রিজ হয়ে গেল হে।”
এবার সুধীর গদগদ হয়ে বলল, “একটু পায়ের ধুলো দিন গোবিন্দবাবু।”
“আহা, থাক থাক। ওসব হবেখন। আগে মন্টুরামের গুমর তো ভাঙুক। ত্রিশ বছর ধরে যে জ্বলুনি-পুড়ুনি সইছি, সেই জ্বালা আগে জুড়োক।”
“বাক্সটা কি সিন্দুকে রাখা থাকে বললেন গোবিন্দবাবু?”
“হ্যাঁ। তবে চিন্তা নেই। সিন্দুকের চাবিটা মস্ত আর ভারী বলে ওটা মন্টুরাম স্ট্রংরুমেই দেওয়ালের পেরেকে ঝুলিয়ে রেখে যায়।”
“নাঃ গোবিন্দবাবু, এবার পায়ের ধুলোটা না নিলে পাপ হয়ে যাবে। দেখবেন একদিন আপনার পায়ের ধুলো নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে। সোনার দরে পুরিয়া করে বিক্রি হবে।”
গোবিন্দবাবু একটু তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, “একটা কথা মনে রেখো বাপু, শুভস্য শীঘ্রম। কথাটার মানে হল, ওরে তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী। আজ হল গিয়ে কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী। পঞ্জিকা দেখে রেখেছি, আজ বড় ভাল দিন।”
“যে আজ্ঞে।”
রাত আড়াইটে নাগাদ যখন গোটা চৈতন্যপুর ঘুমে অচেতন, তখন মন্টুরামের পাহারাদাররা সামান্য তন্দ্রায় আচ্ছন্ন, সড়ালে কুকুরেরা থাবায় মুখ রেখে ঝিমিয়ে নিচ্ছে, মন্টুরাম যখন স্ট্রংরুমে মদন তপাদারের সুটকেসটা আরও একবার দেখে দু’নম্বর মন্টুরামের সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে নীচে নেমে এসে সবে খাটে শুয়েছেন, ঠিক এই সময়ে জোড়া বাঁশের সাঁকো বেড়ালের মতো পেরিয়ে গেল সুধীর গায়েন। এপাশের ছাদে বাঁশ দুটো শক্ত করে চেপে ধরে রেখে গোবিন্দ ঘোষ খুব হাসছিলেন। আহা, এতদিনে তাঁর একটা সাধ পূরণ হল। তিনি বিড়বিড় করে বলছিলেন, “জয় দুর্গা, জয় কালী, জয় বাবা বিশ্বনাথ, জয় মা শীতলা, জয় তারা, কাজটা ভালয় ভালয় উতরে দাও। মন্টুরামের সব যেন চেঁছে-পুঁছে আনতে পারে ছোঁড়া।”