“হ্যাঁ, ফিসফাস যেন তাই বলে গেল।”
হিরু তাড়াতাড়ি হরিশ্চন্দ্রের পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, “মহারাজ, সবই আপনাকে খুলে বলছি। দয়া করে আপনার গুজগুজ আর ফিসফাস ধরে করে আমার কাজটা উদ্ধার করে দিন।”
৬. গোবিন্দ ঘোষের সঙ্গে
গোবিন্দ ঘোষের সঙ্গে যে মন্টুরাম সিংহের চিরকালের আড়াআড়ি, এ কে না জানে। কিন্তু গোবিন্দ ঘোষের কপালের দোষে তাঁর বাড়িটা ওই মন্টুরামের বাড়ির একদম লাগোয়া। গোবিন্দ ঘোষের ফলন্ত মধুগুলগুলি আমগাছের সবচেয়ে বেশি আম ধরে যে ডালটায়, সেটাই মন্টুরামের বাগানের দিকে ঝুঁকে থাকে, গোবিন্দ ঘোষের নারকোলগাছের নারকোল প্রায়ই গিয়ে পড়ে মন্টুরামের বাগানে। ছাদে শুকোতে দেওয়া গোবিন্দ ঘোষের গেঞ্জি আর লুঙ্গি কতবার যে হাওয়ায় উড়ে মন্টুরামের বাড়ির ছাদে গিয়ে পড়েছে, তার হিসেব নেই।
আর ওদিকে মন্টুরামের বাড়িতে মাংস রান্না হলে সেই গন্ধ এসে গোবিন্দ ঘোষের বাড়িতে দাপাদাপি করে বেড়ায়। গোবিন্দ দাঁত কিড়মিড় করেন। মন্টুরামের বাড়িতে বিরিয়ানি হচ্ছে। তার গন্ধ গোবিন্দর বাড়িতে লুঠেরার মতো ঢুকে সব তছনছ করে দেয়। মাছের মুড়ো দিয়ে সোনামুগের ডাল রান্না হলে তো গোবিন্দকে নাকে চাপা দিতে হয়। গন্ধগুলো যেন এসে তাঁকে মুখভেংচি দেয়, বক দেখায়, মাথায় চাঁটি মেরে বলে যায়, “দুয়ো রে গোবিন্দ, দুয়ো!”
গোবিন্দ একদিন মন্টুরামকে উচিত শিক্ষা দিতে তাঁর গিন্নি বাসন্তীকে বললেন, “হ্যাঁ গা, আজ একটু শুঁটকি মাছ রাধা তো।”
বাসন্তী চোখ কপালে তুলে বলেন, “শুঁটকি মাছ! বলো কী। আমরা তো কস্মিনকালেও শুঁটকি মাছ খাই না!”
“আহা, খাওয়ার কথা উঠছে কেন? খাওয়ার জন্য নয় গিন্নি, গন্ধটা ছড়ালে মন্টুরামকে একটু শিক্ষা দেওয়া হবে।”
বাসন্তী রাগ করে বলেন, “আ মোলো, অন্যকে শিক্ষা দিতে গিয়ে শুঁটকি বেঁধে মরি আর কী।”
“তা হলে এক কাজ করো। শুনেছি চামড়া পোড়ালে কী বিচ্ছিরি গন্ধ হয়। তা হলে আমার পুরনো ঘেঁড়া পাম্পশুটা নিভন্ত উনুনে গুঁজে রাখো। দেখি, ব্যাটা দাপিয়ে বেড়ায় কি না।”
বাসন্তী বললেন, “মন্টুবাবু দাপিয়ে বেড়াবে কি না জানি না বাপু, তবে চামড়া-পোড়া গন্ধে আমরাই কি বাড়িতে টিকতে পারব?”
তাই তো! এ কথাটা তো খেয়াল হয়নি! গোবিন্দবাবু খুব ভাবনায় পড়লেন। গত ত্রিশ বছর ধরে গোবিন্দ ভেবেই চলেছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত মন্টুরামকে শিক্ষা দেওয়ার মতো তেমন কিছুই করে উঠতে পারেননি।
এক রাতে গোবিন্দ ঘোষের বাড়িতে চোর ঢুকেছিল। টের পেয়ে গোবিন্দ ঘোষ প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তেড়ে উঠলেন, “এটা তোদের কীরকম একচোখোমি বল তো! পাশেই মন্টুরামের বাড়ি ছেড়ে আমার বাড়িতেই কেন ঢুকেছিস? এ কীরকম বিচার তোদের?”
চোরটা ভড়কে গিয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
গোবিন্দ ঘোষ মশারি তুলে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে হাত-পা ছুঁড়ে বলতে লাগলেন, “লজ্জা করে না তোদের? ঘেন্না হয় না? যার বাড়িতে সোনাদানা উপচে পড়ছে, টাকা রাখার জায়গা নেই, দামি দামি জিনিস ছড়িয়ে পড়ে থাকে, তার বাড়ি ছেড়ে কোন লজ্জায় এ বাড়িতে ঢুকেছিস?”
চোরটা মিনমিন করে বলল, “তা কী করব মশাই, মন্টুরামবাবুর বাড়িতে যে সড়ালে কুকুর আছে, পাইক-বরকন্দাজ আছে।”
গোবিন্দ খাপ্পা হয়ে বললেন, “ওঃ যেন পুষ্যিপুতুর এলেন! কুকুর আছে, পাইক-বরকন্দাজ আছে। আর তাতেই বাবুর জারিজুরি বেরিয়ে গেল! পাইক-বরকন্দাজ আর কুকুরকেই যদি ভয়, তা হলে চুরি ছেড়ে বোষ্টম হলেই পারিস। তোদের মতো চোরকে কুলাঙ্গার বললে কম বলা হয়। এই যদি তোর এলেম, তা হলে গলায় দড়ি দিগে যা। জলে ডুবে মরগে যা। ছিঃ ছিঃ, তোদের মুখদর্শন করলে পর্যন্ত পাপ হয়।”
চোরটা তখন পালাতে পারলে বাঁচে। তবে হঠাৎ এই সেদিন নৈরাশ্যের মধ্যে একটু আশার আলো দেখতে পেলেন গোবিন্দ ঘোষ। গাঁয়ের চৌকিদার ভজহরির কাছে শুনলেন যে, মন্টুরামের বাড়িতে একদিন একটা চোর ঢুকেছিল। কপালের ফেরে সে কিছু চুরি করতে পারেনি, সারারাত একটা আলমারির মধ্যে আটকে থেকে পরদিন মন্টুরামের হাতে ধরা পড়ে যায়। তবে মন্টুরামের বউ হরিমতী তাকে দয়া করে ছেড়ে দেন।
গোবিন্দ ঘোষ খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “চোরটার নাম-ধাম কী জানো? মন্টুরামের বাড়িতে যে ঢুকতে পারে, সে কিন্তু সোজা চোর নয়।”
ভজহরি বলল, “সেটা খুব ঠিক কথা গোবিন্দবাবু। সুধীর গায়েন একজন নাটা চোর বটে, কিন্তু কাজের লোক। চোর দেখে দেখে তো আমার চোখ পেকে গিয়েছে, তাই দেখলেই চিনতে পারি।”
“তা সে কোথায় থাকে বলো তো?”
“এ গাঁয়ের লোক নয়, তবে এখানে-সেখানে খুঁজলে পেয়ে যাবেন। চার ফুটিয়া চোর। রোগা চেহারা। কালও দেখেছি দুপুরে কালীবাড়ির চাতালে বসে মুড়ি-তেলেভাজা খাচ্ছে।”
এ চোরকে খুঁজে বের না করলেই চলছে না। সুতরাং গোবিন্দ ঘোষ তক্কেতক্কে রইলেন। দিন দুইয়ের মাথায় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে রথতলা বাজারে কেষ্ট সাহুর দোকানের সামনে পেয়েও গেলেন তাকে। ছোটখাটো মানুষ, বসে মুড়ি আর ঘুগনি খাচ্ছে।
“সুধীর গায়েন নাকি হে তুমি?”
সুধীর একটু অবাক হয়ে বলে, “যে আজ্ঞে।”
বেঞ্চে তার পাশেই জুত করে বসে গোবিন্দ ঘোষ বললেন, “ওহে সুধীর, ইংরিজিতে একটা কথা আছে জানো? ট্রাই-ট্রাই-ট্রাই এগেন। ওর বাংলা করলে দাঁড়ায় একবারে না পারিলে দ্যাখো শতবার।”