“তা কে জানে মহারাজ। শুধু জানি, মন্তর হলেও ও মন্তর আমাদের জন্য নয়।”
হরিশ্চন্দ্ৰ হতাশ হয়ে বললেন, “তা হলেই তো মুশকিল।”
“তবে লোকটার সঙ্গে ভাবসাব করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। মনে হয়, মাস দুয়েকের চেষ্টায় একটু-একটু যেন ভাবসাব হয়ে উঠছিল। সেই সময়ে আমি একটা ভুল করে ফেলেছিলাম মহারাজ। সোনার গাঁয়ে একটা আড্ডায় কিছু লোক আমার ম্যাজিক নিয়ে খুব ঠাট্টা-তামাশা করছিল। তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য সেদিন আমি ভারী মাথা গরম করে তাদের আয়নাটা দেখাই। দেখে তারা ভড়কে গেল ঠিকই। কিন্তু গুপ্ত রহস্যটা গেল ফাঁস হয়ে। আর লোকগুলোও সেই থেকে আমার পিছনে লাগল। কেউ টাকা সাধল, কেউ ভয় দেখাতে লাগল, আয়নার লোকটাও ভ্রু কুঁচকে আমাকে কীসব যেন বলেছিল। নিশ্চয়ই ভাল কথা নয়।”
“তারপর কী হল?”
“তারপর থেকে আমি একরকম ফেরার হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। আজ এখানে, কাল সেখানে। আয়নার লোকটা তখন আমাকে প্রায়ই বলত, টিকিটাক, টিকিটাক।”
হরিশ্চন্দ্র সাগ্রহে বললেন, “ওর মানে কি ‘টিকে থাক’ নাকি?”
“কে জানে মহারাজ, তাও হতে পারে। তবে টিকে আর থাকতে পারলাম কই বলুন!”
“কেন হে বাপু? কী হল?”
“ঘুরতে ঘুরতে চৈতন্যপুরে হাজির হয়েছিলাম মহারাজ। ঠিক করে রেখেছিলাম, একটা সুবিধেমতো জায়গা পেলে আয়নাটা লুকিয়ে রাখব। তা আপনার এই রাজবাড়িটা দেখে মনে হল, এমন ভাল জায়গা আর পাওয়া যাবে না। মেলা গুপ্তঘর আর কুঠুরি, কুলুঙ্গি, তাক, পুরনো বাক্সপ্যাটরার অভাব নেই। তাই সন্ধের মুখে চুপিসারে ঢুকে আয়নাটা কুলুঙ্গিতে হাবিজাবি জিনিসের পিছনে গুঁজে রেখে দিলাম। ধুকধুকিটা আমার কাছে রাখলাম। আয়নাটা কেউ খুঁজে পেলেও ধুকধুকি ছাড়া সেটায় কাজ হবে না।”
হরিশ্চন্দ্র উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসে বললেন, “বলো কী! এই বাড়িতে?”
“যে আজ্ঞে। শুধু শুধু কি আর এ বাড়িতে থানা গেড়ে আছি। মশাই?”
“তা আয়নাটা এখন কোথায়? একবার দেখা যায় না?”
মাথা নেড়ে লোকটা বলল, “নেই। সেটা হাওয়া হয়েছে।”
৫. সে এক ম্যাজিকওলার ছেলে
সে এক ম্যাজিকওলার ছেলে, যে ম্যাজিকওলা মাঝে মাঝেই অদৃশ্য হয়ে যেত, দিনের পর দিন তার দেখা পাওয়া যেত না। হিরুর মা ছিলেন না, এক বুড়ি দিদিমার কাছে মানুষ। বড্ড অনাদর ছিল তার, তাই সে হাপিত্যেশ করে বাবা কবে ফিরে আসবেন, তার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকত।
অনেক-অনেক দিন পরে পরে বাবা হয়তো ফিরে আসতেন, কিন্তু বড্ড রোগা চেহারা নিয়ে, ধুকতে ধুকতে। তবু বাবা এসে তাকে পয়সা দিতেন। খাবার কিনে আনতেন, খেলনাও দিতেন একটা-দুটো। বাবা যে তার জন্যই রোজগার করতে গিয়ে গাঁয়ে গ্রামান্তরে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়ান, তা হিরু জানত। বড় কষ্ট হয় বাবার জন্য। বাবার সঙ্গে চলে যেতেও ইচ্ছে হত তার। কিন্তু বাবা রাজি হতেন না। বলতেন, “তুমি পড়াশোনা করো, আমার মতো জীবন তোমার জন্য নয় বাবা।”
সে এক বর্ষার রাত। হিরুর স্পষ্ট মনে আছে। বাবা সেদিনই বাড়ি ফিরেছেন, তাই হিরুর মনে ভারী আনন্দ। রাতে বাবার বুক ঘেঁষে শুয়ে সে মহা আরামে ঘুমিয়েছিল। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখতে পেল, বাবা একটু দুরে মেঝের উপর বসে একটা হাত আয়নার দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন। ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল সে। আয়নার সঙ্গে কি কেউ কথা বলে?
চুপ করে শুয়ে চোখ সামান্য ফাঁক করে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দৃশ্যটা দেখছিল। হঠাৎ বুঝতে পারল, বাবা নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে প্রলাপ বকছেন না। আয়নায় দাড়ি-গোঁফওলা একটা অচেনা মুখ। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল হিরু।
ওটা কি ভুতুড়ে আয়না? বাবা কি ভূত-প্রেতের খেলা দেখান? হিরু কিছুই বুঝতে পারল না। তবে সেই ছোট বয়সেও সে বাবার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পেরেছিল, বাবা আয়নার ভূতটার সঙ্গে ভাব করতে চাইছেন।
পরপর দু’রাত একই ব্যাপার ঘটবার পর একদিন হিরু ঠিক করল, ব্যাপারটা দেখতে হবে। আয়নায় কথা বলার সময় বাবা যে গলায় ধুকধুকিটা ঝুলিয়ে নেন, এটা তার নজর এড়ায়নি।
সেদিন তার বাবা মদন তপাদার গাঁয়ের যাত্রা দেখতে গিয়েছেন। নিরালা ঘরে হিরু বাক্স খুলে আয়নাটা বের করল। এমনিতে আয়নাটা সাধারণ আয়নার মতোই। কিন্তু যেই গলায় লকেটটা ঝুলিয়ে নিল, সঙ্গে সঙ্গে আয়নায় একটা ভয়ংকর মুখ ভেসে উঠল। মাথায় লোহার টুপি, গালে দাড়ি-গোঁফ, চোখদুটো যেন জ্বলছে। সে পরিষ্কার শুনতে পেল, লোকটা উত্তেজিত গলায় অদ্ভুত এক ভাষায় কিছু বলতে চাইছে। ‘হুররা… হুরো … বুরুচ… পিরো…’ এই ধরনের কথা। প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও হিরু বুদ্ধিমান ছেলে। সে খুব নরম করে বলল, “আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
লোকটা ভ্রু বেঁকাল। তারপর মুখের কাছে একটা হাত তুলে বলল, “রবিয়াল… রবিয়াল…।”
কথাটার মানে বুঝল না হিরু। কিন্তু তার কচি মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। গলার লকেটটার মধ্যে কোনও ব্যাপার নেই তো! সে তাড়াতাড়ি লকেটটা তুলে ভাল করে দেখল। মনে হল পালোয়ানের খোদাই করা ছবির বুকে একটা সূক্ষ্ম ফুটো আছে। সে ফুটোটার কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
লোকটা এবার বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে একটু হাসল।
লোকটার কথা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারল হিরু। লোকটা বলল, “তোমার খুব বুদ্ধি। আমার নাম বুরুচ। আমি অনেক অনেক দূরে থাকি।”