আজ রাতে ঘুম ভেঙে হরিশ্চন্দ্র দেখলেন, ট্রাপিজের সেই খেলোয়াড়টি আজ একটা ঝাড়বাতির উঁটিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। মুখটা চিন্তিত।
হরিশ্চন্দ্র গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, “বাপু হে, আজ যে একটু মনমরা দেখছি।”
লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তা একটু চিন্তায় আছি বটে মহারাজ।”
“তা ভাল। চিন্তা বহাল থাকলে আমার বুকের উপর দিয়ে তোমার ওই প্রাণঘাতী লাফঝাঁপগুলো অন্তত বন্ধ থাকবে। তা বাপু, তোমার সমস্যাটা কীসের?”
“আচ্ছা রাজামশাই, আপনি কি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর নাম জানেন?”
“রক্ষে করো বাপু, কোটি দূরে থাক, আমি তেত্রিশজনেরও নাম বলতে পারব না।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “সেইটেই হয়েছে মুশকিল। কেউই পারে না।”
“কেন বাপু, দেবদেবী নিয়ে বখেড়া কীসের?”
“আচ্ছা, অপদেবতাদের কথা কিছু জানা আছে রাজামশাই?”
“না হে, অপদেবতা আছে বলে শুনেছি বটে, কিন্তু তারা যে কারা, তা জানা নেই। রাজপুরোহিত কোকিলেশ্বর ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞেস করা যেত, কিন্তু তাঁর এখন একশো তিন বছর বয়স চলছে। সব কথা মনে করতে পারেন না। আমার মতোই ভুল দ্যাখেন, ভুল শোনেন, ভুল বোঝেন আর ভুল বলেন। তা এইসব উচ্চকোটির ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী তোমার?”
লোকটা করুণ মুখে হরিশ্চন্দ্রের দিকে চেয়ে বলল, “বড়ই দরকার পড়েছে রাজামশাই। সবটা না বললে বুঝতে পারবেন না।”
হরিশ্চন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “বাপু হে, আগে তো এ বাড়িতে গল্প শোনানোর জন্য মাইনে করা লোক ছিল। তা সেসব দিন কবেই গত হয়েছে। শুনেছি, তারা এমন সব গল্প বলত যে, তা শুনে রাজারাজড়ারা নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। তা আজ তোমার গল্পটাই শুনি, দেখি ঘুম আসে কি না।”
লোকটা বলল, “আমি যখন পেটের দায়ে গায়ে-গঞ্জে হাটে বাজারে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতাম, তখন ফুলপুকুরের বিখ্যাত শিবরাত্রির মেলায় খেলা দেখিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। সন্ধে হয়ে আসছিল। বিদ্যেধরীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ সামনে ঘাসের উপর কী একটা জিনিস চকচক করছে দেখে কুড়িয়ে নিলাম। দেখি একটা আয়না। গাঁয়ের হাটে-বাজারে যেমন কাঠের ঢাকনাওয়ালা সস্তা আয়না বিক্রি হয়, তেমনি। আয়নার সঙ্গে একটা লোহার সরু চেনে বাঁধা ধুকধুকিও পড়ে ছিল। তাতে এক পালোয়ানের ছবি খোদাই করা। একবার ভাবলাম, কার না কার জিনিস, ফেলে রেখেই যাই। তারপর ভাবলাম, পড়ে-পাওয়া জিনিস, থাক ঝোলার মধ্যে। তারপর আর দ্রব্য দুটোর কথা মনেই ছিল না। একদিন ঝোলা ঘাঁটতে গিয়ে আয়না আর ধুকধুকিটা বেরিয়ে পড়ল। আয়নাটা বেশ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলাম, ঢাকনাওলা সস্তা আয়নাই বটে, কিন্তু কাঁচটা বেশ ভাল জাতের। কোনও ঢেউ বা ঢাল নেই। আর ধুকধুকিটা দেখে ভাবলাম, কে জানে বাপু ধুকধুকি তো আসলে কবচ। এতে হয়তো আমার কপাল ফিরে যেতেও পারে। এই ভেবে ধুকধুকিটা গলায় পরে ফেললাম। আর তার পরেই ঘটনাটা ঘটল।”
হরিশ্চন্দ্র উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “কী ঘটল হে?”
“ধুকধুকিটা গলায় পরে আয়নায় তাকাতেই আঁতকে উঠে দেখি, তাতে আমার মুখের বদলে অন্য একটা মুখ ফুটে উঠেছে। কটা রঙের দাড়ি-গোঁফ, বড় বড় গোল গোল রাগী চোখ, ঘন জোড়া ⇒, মাথায় লোহার টুপি, পরনে সোনালি রঙের পোশাক। ভয়ের চোটে আমার হাত থেকে আয়নাটা মেঝেয় পড়ে গেল। কিন্তু ভাঙল না। প্রথমটা ঘাবড়ে গেলেও চোখের ভুল ভেবে আয়নাটা তুলতেই আবার সেই মুখ। আর আশ্চর্যের বিষয়, আয়নার লোকটা আমাকে কী যেন বলছিল।”
হরিশ্চন্দ্র অবাক হয়ে বলেন, “বলো কী! তা কী বলছিল?”
“জীবনে ওরকম ভাষা শুনিনি। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি বা সংস্কৃত নয়। একেবারে অচেনা ভাষা। এক বর্ণ বুঝতে পারলাম না। ভূত বলে মনে হয়েছিল বটে, কিন্তু ভূতেরও তো কিছু নিয়মকানুন আছে। উদয় হতে তাদের আয়নার দরকার হয় না। একটা মজা হল, ধুকধুকিটা গলা থেকে খুলে ফেললে আয়নার লোকটা উধাও হত। তখন আয়নাটা একদম সাধারণ আয়না হয়ে যেত।”
“তা তুমি করলেটা কী?”
“আয়নার লোকটা দেবদেবীর কেউ কি না, না কি অপদেবতা, আমাকে কী-ই বা বলতে চাইছে, তা বুঝবার জন্য আমি প্রতিদিনই আয়নার লোকটার সঙ্গে আমার ভাষায় কথা বলতাম। লোকটা আমার কথা বুঝবার চেষ্টাও করত। কিন্তু বুঝতে পারত না। একদিন রাতে খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, প্রচণ্ড বজ্রপাত। হঠাৎ আয়নার লোকটা একটা ধমক দিয়ে বলে উঠল, ‘রোবোশ! রোবোশ! ব্যস, হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি সব থেমে গেল। কাণ্ড দেখে তো আমি অবাক। সেদিন টের পেলাম, আয়নার মানুষটা সোজা লোক নয়। অনেক ক্ষমতা।”
“দাঁড়াও বাপু, রোবোশ কথাটা টুকে রাখি। কাজে লাগতে পারে।”
লোকটা হেসে বলল, “সে গুড়ে বালি। আমি চেষ্টা করে দেখেছি মহারাজ, কাজ হয় না। ময়নাগড়ে এক বাড়িতে একবার রাতে আমাকে তাদের লকড়িঘরে শুতে দিয়েছিল। মেটে ঘর, ডাঁই করা কাঠকুটো আর বাজে জিনিস। রাতে দেখি, একটা কেউটে সাপ তার দশ-বারোটা ছানাপোনা নিয়ে কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরে। তখনও আয়না থেকে ওই লোকটা হঠাৎ চাপা গলায় বলেছিল, ‘পিরো! পিরো!’ সঙ্গে সঙ্গে সাপগুলো পড়ি কি মরি করে পালিয়ে গিয়ে গর্তে ঢুকে পড়ল।
“এ কথাটাও লিখতে বারণ করছ কি?”
“লিখতে পারেন, তবে কাজ হবে না।”
“ওই রোবোশ বা পিরো ওসব কি মন্তর-তন্তর নাকি?”