ঠিক এই সময় ঘাড়ে শ্বাস ফেলার মতো কাছ থেকে দু’নম্বর মন্টুরাম বলে উঠলেন, “আছে হে আছে। দেখার চোখ থাকলে ঠিকই দেখতে পেতে।”
মন্টুরাম ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “এতই যদি জানো, তবে বলে দিলেই তো হয়। তোমাকে দিয়ে তো আজ পর্যন্ত কোনও উপকার হল না। কাজে বাগড়া দিতে এসে হাজির হও।”
“বলি সব কিছু খুঁটিয়ে দেখেছ তো?”
“কিছুই বাকি রাখিনি হে। ম্যাজিকের সামগ্রী ছাড়া আর আছে একটা ধুকধুকি। তা সেটা আলাদিনের পিদিম কি না জানি না। নেড়ে-ঘেঁটে, ঘষে-মেজে দেখেছি বাপু, কোনও মহিমা প্রকাশ হয়নি। আর ওই উপরের পকেটে একটা ছোট ছেলের ফোটো আছে। পিছনে নাম লেখা হিরু। তা এই হিরুটা কে অবিশ্যি জানা নেই।”
“হুঁ। বিশ বছর আগেকার ফোটো। হিরুর চোখদুটো দেখেছ? খুব জ্বলজ্বলে কিন্তু। মনে হয় ভবিষ্যতে বেশ কঠিন মানুষ হবে।”
“ওরে বাপু, হিরুর খবরে আমাদের দরকার কী?”
“না, এই বলছিলাম আর কী। হিরু বেঁচে থাকলে এখন তার বয়স সাতাশ-আঠাশ হবে।”
“তা হোক না। কাজের কথায় এসো তো বাপু। এই বাক্সে কি কোনও গুপ্ত পকেট বা ফাঁকফোকর আছে? তাতে কি গুপ্তধনের নিশানা পাওয়া যাবে?”
দু’নম্বর মন্টুরাম হঠাৎ হাঃ হাঃ করে হেসে বলেন, “তুমি আর গুপ্তধন নিয়ে কী করবে বলো তো মন্টুরাম? তোমার যা আছে তাই তো সাতপুরুষে খেয়ে ফুরোতে পারবে না।”
মন্টুরাম ফুঁসে উঠে বললেন, “বাজে বোকো না তো! টাকা কি কারও বেশি হয় নাকি? আরও টাকা হলে আরও কত কী করা যায়।”
.
রাত আড়াইটে নাগাদ রাজা হরিশ্চন্দ্রের ঘুম ভেঙেছে। আর ঘুম ভাঙলেই যত উদ্ভুটে ঘটনা ঘটতে থাকে। এই তো সেদিন ঘুম ভেঙে দ্যাখেন, রসময় পণ্ডিতমশাই বসে আছেন। বললেন, “ওরে হরি, আজ তোকে সমাস চ্যাপটারের পড়া ধরব। বল তো ‘ভর্তৃহরি’ কী সমাস!” হরিশ্চন্দ্র মহা ফাঁপরে পড়ে আমতা আমতা করছিলেন। এমন সময় ঝড়ের মতো তাঁর তিন পিসি এসে হাজির। কানা পিসি বলল, “ও পণ্ডিত, ওরকম দুধের বাছাকে অমন শক্ত শক্ত প্রশ্ন করতে আছে? সোজা সোজা প্রশ্ন করো তো বাপু। আস্তে আস্তে শিখবে।”
রসময় ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “প্রশ্রয় দিয়ে দিয়েই তো আপনারা ছেলেপিলেগুলোকে নষ্ট করেন,” বলে ভারী রাগ করে উঠে গেলেন রসময়।
আর একদিন অম্বুরি তামাকের গন্ধে উঠে বসে হরিশ্চন্দ্র দ্যাখেন, তাঁর ঠাকুরদা মহিমচন্দ্র গদিআঁটা চেয়ারটায় বসে গড়গড়া টানছেন। হরিশ্চন্দ্র তাড়াতাড়ি কোমরের ব্যথা, হাঁটুর কটকটি উপেক্ষা করে প্রণাম করে দাঁড়াতেই মহিমচন্দ্র বজ্রনির্ঘোষে বললেন, “ওরে হরি, এসব কী দেখছি? হাতিশালে হাতি নেই, ঘোড়াশালে ঘোড়া নেই, গোশালা ফাঁকা। দাসদাসীগুলো সব উবে গেল নাকি? প্রাসাদের চুড়ো হেলে পড়েছে, পুকুরে ভরতি কচুরিপানা!”
হরিশ্চন্দ্র ভয়ে ভয়ে বললেন, “আজ্ঞে, খাজনাটা আদায় হলেই সব হয়ে যাবে।”
“আরও একটা কথা শুনছি। কোনও বেয়াদব নাকি তোর কাছে রাজবাড়ি কিনে নেবে বলে প্রস্তাব পাঠিয়েছে।”
“আজ্ঞে মহারাজ। মন্টুরাম সিংহ।”
“তার এত সাহস?”
“দশ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিল।”
মহিমচন্দ্র চোখ কপালে তুলে বললেন, “দশ লাখ! সে তো অনেক টাকা!”
“আজ্ঞে না। সেই আমলের সঙ্গে তুলনা করলে এখনকার দশ লাখ তখনকার হাজার পাঁচ-ছয়ের বেশি হবে না।”
“পাইক-বরকন্দাজ পাঠিয়ে লোকটাকে বেঁধে এনে বিছুটি দিতে পারিস না?”
হরিশ্চন্দ্র ভালই জানেন মন্টুরামের অনেক টাকা, মেলা পাইক বরকন্দাজ। তাঁকে বেঁধে আনার সাধ্যি হরিশ্চন্দ্রের নেই। তাই মিনমিন করে বললেন, “আজ্ঞে, সে আর বেশি কথা কী! তবে কিনা পুকুরধারের বিছুটি গাছগুলো লোপাট হয়েছে। ইতুপুর থেকে বিছুটি আনিয়ে তবে…।”
“হ্যাঁ, বেশ করে আগাপাশতলা ঝেড়ে দিবি।” হরিশ্চন্দ্র জানেন যে, তিনি ভুলভাল দেখেন, ভুলভাল শোনেন, ভুলভাল বোঝেন এবং ভুলভাল বলেন। কিন্তু সবটাই ভুল কি না সন্দেহ হয় মাঝে মাঝে। এই পরশু রাত্তিরে তিন পিসি এসে হাজির। কুঁজো পিসি বলল, “হ্যারে হরি, তোর জিব কি অসাড়? আর স্বাদসোয়াদ টের পাস না? রোজ যে দুধটুকু খাস, আমি আজ তার এক ফোঁটা জিবে ঠেকিয়ে দেখলুম, ও তো পিটুলিগোলা! গয়লাটাকে নাগরা জুতো দিয়ে ঘা কতক দিতে পারিস না?”
হরিশ্চন্দ্রের নাগরা জুতোই নেই। হাতের জোরই নেই। চুপ করে রইলেন।
তখন হঠাৎ কানা পিসি দুটো গিনি তাঁর বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “তোর অবস্থাটা ভাল যাচ্ছে না জানি। তা ওটা ভাঙিয়ে একটু ভাল-মন্দ খা তো বাছা।”
খোঁড়া পিসি বলল, “দেখিস বাবা, লোভে পড়ে আবার নাদু মালাকারের কাছে আমাদের বেচে-টেচে দিসনি যেন।”
হরিশ্চন্দ্র শশব্যস্তে বললেন, “না পিসিগণ, নাদুকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি।”
কুঁজো পিসি বলল, “তাড়িয়ে তো দিয়েছিস বাছা, কিন্তু সে তো প্রাসাদের এখানে-সেখানে এখনও হাঁড়ি নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে।”
ব্যাপারটা যদি স্বপ্নই হবে, তা হলে সকালে ঘুম ভেঙে হরিশ্চন্দ্র সত্যি সত্যিই বিছানায় দুটো চকচকে গিনি পেতেন না। রাজবাড়ির পুরনো স্যাকরা নবকৃষ্ণ এসে কষ্টিপাথরে ঘষে বলল, “নাঃ, সোনাটা বড় ভাল। ওজনও কম নয়।”
গতকালই বেশ কয়েক হাজার টাকা পেয়ে হরিশ্চন্দ্রের মনটা আবার আশায়-আশায় আছে। পিসিমাগণ হয়তো সত্যি সত্যিই তাঁদের লুকনো সোনাদানা একটু একটু করে বের করবেন।