কিন্তু ইদানীং যে নতুন দুঃখটা এসে হাজির হয়েছে, সেটা হল দু’ নম্বর মন্টুরাম। আর এই দু’নম্বর মন্টুরামের সঙ্গে মন্টুরামের একেবারেই বনিবনা হচ্ছে না। উড়ে এসে জুড়ে বসা এই দু’নম্বর মন্টুরাম যখন-তখন, যেখানে-সেখানে ফস করে উদয় হয়ে মন্টুরামকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছেন।
এই তো সেদিন তিনশো টাকা কিলো দরে সরেস ইলিশ মাছ এনেছিলেন মন্টুরাম। রান্নাটাও হয়েছিল ভাল। সবে ইলিশের বাটি কাছে টেনেছেন, এমন সময় দু’নম্বর মন্টুরাম আড়াল থেকে বলে উঠলেন, “মন্টুরাম, ইলিশ মাছ খাচ্ছ নাকি?”
মন্টুরাম হুংকার দিয়ে বললেন, “খাচ্ছিই তো! কার বাবার কী?”
“সে তো বটেই। একটু আগে নোনাপাড়ায় দেখে এলাম ষষ্ঠীর বিধবা মা পান্তাভাত নিয়ে বসেছে, সঙ্গে নুন ছাড়া কিছু নেই। শিকেয় ঝোলানো মেটে হাঁড়িতে এক ছড়া তেঁতুল খুঁজছিল। না পেয়ে কপাল চাপড়ে নুন দিয়েই সাঁটছে। অবশ্য তাতে তোমার কীই বা এল-গেল মন্টুরাম। তুমি খাও।”
খেলেন মন্টুরাম। তবে ইলিশ মাছটা গঙ্গামাটির মতো লাগছিল।
এই তো সেদিন নগেন বাঁড়ুজ্যের সঙ্গে বিষয়সম্পত্তি ঘটিত মামলায় হাইকোর্টের রায় বেরোল। মন্টুরাম জিতে গিয়েছেন। এখন নগেন বাঁড়ুজ্যের বসতবাটিসহ গোটা সম্পত্তিই মন্টুরামের দখলে। আনন্দের চোটে মন্টুরাম নন্দকিশোরের দোকান থেকে তার বিখ্যাত ক্ষীরকদম এক হাঁড়ি কিনে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ কোথা থেকে দু’নম্বর মন্টুরাম গাড়ির পিছনের সিটে যেন ঠিক তার পাশেই বসে খুব করুণ গলায় বললেন, “মন্টুরাম, মনে পড়ে?”
মন্টুরাম খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “কী মনে পড়বে?”
“সেই যে যখন ছোটটি ছিলে, তখন প্রতি বেস্পতিবার গিয়ে প্রসাদের লোভে নগেনদের বাড়িতে গুটিগুটি হাজির হতে! আর নগেনের মা কলাপাতায় নাড়ু, মোয়া, বাতাসা আর ফলের টুকরো দিতেন হে! মনে নেই?”।
মন্টুরাম ধমক দিয়ে বললেন, “তাতে কী হল? মাথা বিকিয়ে গিয়েছে নাকি?”
“মন্টুরাম, বলছিলাম কী, মামলায় হেরে সর্বস্ব খুইয়ে আজ রাতে যদি নগেন বাঁড়ুজ্যে গলায় দড়ি দেয়, তা হলে ওই ক্ষীরকদম তোমার গলা দিয়ে নামবে তো? ভাল করে ভেবে দ্যাখো বাপু। ক্ষীরকদম ভাল জিনিস বটে, কিন্তু ভাল জিনিস তখনই ভাল, যখন তার আগু-পিছুটাও ভাল হয়।”
মন্টুরাম হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “তা হলে কী করতে হবে?”
“অন্তত বসতবাড়িটা ছেড়ে দাও। নগেনের দাঁড়ানোর জায়গা নেই।”
মন্টুরাম তেড়ে উঠে বললেন, “আর আমার অত টাকা!”
দু’নম্বর মন্টুরাম বললেন, “লোকে যে বলে তোমার টাকশাল আছে, সে তো আর এমনি নয়। নগেনের তো চেঁকিশালটাও নেই।”
মন্টুরাম মাথা নাড়া দিয়ে বললেন, “না হে দু’নম্বর মন্টুরাম, এভাবে বিষয়কৰ্ম চলে না। এরকম চলতে থাকলে যে আমি পথে বসব।”
কিন্তু দু’নম্বর মন্টুরাম একা নয়। তার সঙ্গে হরিমতীরও যোগসাজশ আছে। রাত্রিবেলা হরিমতীও কাঁদতে বসলেন। বললেন, “ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি, তাদেরও তো ভালমন্দ আছে। বামুন মানুষকে ভিটেছাড়া করলে কি আমাদের ভাল হবে ভেবেছ! আমি অতশত জানি না বাপু, তুমি ওদের ভিটেমাটি ফিরিয়ে দাও।”
রাগে ফুসতে ফুসতে দাঁতে দাঁত চেপে তাই করতে হল মন্টুরামকে। দু’নম্বর মন্টুরামকে সামনে পেলে যেন চিবিয়ে খান।
তা এইভাবেই মন্টুরামের সঙ্গে দু’নম্বর মন্টুরামের শত্রুতা বেড়েই চলেছে।
মন্টুরামের বড় ছেলে নন্দরামের বিয়ে ঠিক হল সেদিন। কনেপক্ষ এসেছিল দানসামগ্রী নিয়ে কথা কইতে। এক লাখ টাকা নগদ আর পঞ্চাশ ভরি সোনা। সঙ্গে টিভি, ফ্রিজ, একখানা মোটরবাইক ইত্যাদি। পাটিপত্র সইসাবুদ হতে যাচ্ছে, ঠিক এই সময় দু’নম্বর মন্টুরামের গলা শুনতে পেলেন মন্টুরাম। কানের কাছে ফিসফিস। দু’নম্বর বললেন, “সবই তো হল, কিন্তু একটাই মুশকিল হে মন্টুরাম।”
মন্টুরাম গম্ভীর হয়ে বললেন, “কীসের মুশকিল?”
“নতুন বউ এসে যখন তোমাকে পেন্নাম করবে, তখন কিন্তু মনে মনে সে তোমার কানও মলে দেবে। যতবার তোমার মুখের দিকে চাইবে, ততবার মনে মনে তোমার মুখে থুতু দিতে ইচ্ছে যাবে তার।”
“কান মলবে! থুথু দেবে! বলো কী?”
“শুধু কি তাই! যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন ঘেন্না করবে তোমাকে।”
“অ্যাঁ!”
“ভেবে দ্যাখো মন্টুরাম। এক লাখ টাকা, পঞ্চাশ ভরি সোনা আদায় করে সুখ হবে তো? টাকায় মেলা জিনিস কেনা যায় বটে, কিন্তু ছেদ্দা-ভক্তি যে দোকানে বিকোয় না হে। বিকিকিনির বাজারে ও জিনিস পাবে না। ভেবে দ্যাখো।”
পারলে দু’নম্বর মন্টুরামের মুন্ডুটা ছিঁড়েই ফেলতেন মন্টুরাম। কিন্তু সে উপায় নেই। হাত নিশপিশ করে, দাঁত কড়মড় করে, কিন্তু মন্টুরামের দু’ নম্বর মন্টুরামকে ছোঁয়ারও উপায় নেই।
রাত দুটো। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। দূরে শেয়ালের ডাক। ঝিঁঝির শব্দ। মন্টুরাম নিঃশব্দে উঠে তিনতলায় তাঁর স্ট্রং রুমে গিয়ে ঢুকলেন। তারপর বড় সিন্দুকটা খুলে জাদুকর মদন তপাদারের ছেঁড়াখোঁড়া সুটকেসটা বের করলেন। তারপর ডালাটা খুলে খুব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। রোজই করেন। একজন পেঁয়ো আর গরিব বাজিকরের যা যা থাকে, সে সবই রয়েছে। বাক্সটায়। এমন কোনও আহামরি বস্তু নেই, যার জন্য বাড়িতে চোর এলে হানা দেবে কিংবা ষণ্ডাগুন্ডারা হন্যে হয়ে উঠবে। মন্টুরাম অবশ্য ঘাবড়াননি। তাঁর লোকবল দারুণ। সুধীর গায়েন হানা দেওয়ার পর তিনি বাড়ি পাহারা দেওয়ার আরও মজবুত ব্যবস্থা করেছেন। নতুন পাইক রাখা হয়েছে। কানাই দারোগা দু’জন সেপাই মোতায়েন রেখেছেন। কিন্তু এত বন্দোবস্ত করা হল যে কারণে, সেই বাক্সের রহস্যই তো বুঝতে পারছেন না মন্টুরাম।