“আর একটু কথা ছিল বাপু। কানাঘুষো শুনেছি, দশ-বারো বছর আগে তোমার যখন ছোঁকরা বয়স, সে সময় তুমি নাকি জাদুকর মদন তপাদারের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলে?”
সুধীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “অ্যাসিস্ট্যান্ট বললে বাড়াবাড়ি হবে। তবে আমি তাঁর তল্পিতল্পা বইতাম বটে। ইচ্ছে ছিল, ম্যাজিক শিখে আমিও খেলা দেখিয়ে বেড়াব।”
“তা শিখলে?”
“শিখেছিলাম। তবে তাঁর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বুঝলাম যে, ম্যাজিকের তেমন বাজার নেই। মদনবাবু তেমন বড় ম্যাজিশিয়ান তো ছিলেন না। আগে সার্কাসে ট্রাপিজের খেলা দেখাতেন। অনেক টাকা মাইনে ছিল। পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে যাওয়ায় সার্কাসের চাকরি যায়। তখন পেটের দায়ে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতেন।”
“তা বাপু, তার ম্যাজিকের বাক্সখানা তো তুমি নিশ্চয়ই মেলা নাড়া-ঘাঁটা করেছ? তাতে কী ছিল মনে আছে?”
“তা থাকবে না কেন? আমিই তো গুছিয়ে রাখতুম। কিন্তু বিশেষ কিছুই ছিল না মশাই। গোটা আষ্টেক থ্রোয়িং নাইফ, কয়েকটা লোহার বল, কয়েক প্যাকেট তাস, আর ম্যাজিকের চোঙা, খেলনা পিস্তল, মন্ত্ৰপড়া রুমাল, এইসব আর কী!”
“আর কিছু?”
“একটা ধুকধুকি ছিল, মনে আছে। মদনবাবু সেটায় হাত দিতে বারণ করতেন। দস্তার একটা চৌকোমতো কাঁচ, তাতে একটা পালোয়ানের ছবি খোদাই করা। আমি অনেক নেড়ে-ঘেঁটে দেখেছি মশাই, তা থেকে দৈত্য-দানো কিছুই বেরোয়নি।”
“মদনবাবু যে রাতে নিরুদ্দেশ হন, সে রাতে তুমি তার কাছে ছিলে?”
ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুধীর বলে, “ছিলুম মশাই। এক বন্ধুর বাড়িতে তার বোনের বিয়ের ভোজ খেয়ে অনেক রাতে এসে মদনবাবুর পায়ের কাছে বস্তা পেতে শুয়েছিলুম।”
“তারপর?”
“তারপর শুনবেন? সেটা আমার পক্ষে বড় লজ্জার কথা। তবে অনেক দিন হয়ে গিয়েছে, এখন বলতে লজ্জা নেই। তার উপর এত টাকা দিলেন, তারও তো একটা প্রতিদান আছে! সেই রাতে মন্টুরামের বাড়িতে আমি চুরি করে পালিয়ে গিয়েছিলাম।”
“বটে!”
“হ্যাঁ! পলকা দরজা দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। আমার ভিতরকার ঘুমন্ত চোরটা জেগে উঠেছিল। কিছু বাসনকোসন, একটা ঘড়া, সাইকেল আর ঘড়ি। পরে শুনেছি মন্টুরাম আর তার বাড়ির লোকেরা চোর বলে মদনবাবুকে খুব অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।”
“তোমার সঙ্গে মদন তপাদারের আর দেখা হয়নি?”
“আজ্ঞে না। খুব মনস্তাপ হয়েছিল আমার। গাঁয়ে-গঞ্জে, হাটে বাজারে আমি অনেক খুঁজে দেখেছি। মনে হয় ম্যাজিকের বাক্সটা হাতছাড়া হওয়ায় মদনবাবু না খেয়েই মারা গিয়েছেন। সেইজন্য আমি অনেকদিন কান্নাকাটি করেছি। মদনবাবু ভালই জানতেন চুরিটা আমিই করেছিলাম, তবু মন্টুরামের কাছে আমার নাম বলেননি।”
“বাক্সটা দেখলে চিনতে পারবে?”
“সে কী কথা! ও বাক্স মাথায় করে করে মদনবাবুর সঙ্গে কি কম ঘুরেছি মশাই! সেই ঘেঁড়াখোঁড়া বাক্সটার যে এখন এত দাম হবে, কে জানত! ভয়ংকর-ভয়ংকর সব লোকেরা বাক্সটার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে।”
“তারা কারা জানো?”
“কালোবাবু আর ফুটু সর্দার। দু’জনেই সাংঘাতিক লোক মশাই। কিন্তু ওই বাক্সের মধ্যে কী এমন আছে, তাই তো ভেবে পাই না।”
“হু, চিন্তার কথাই হে।”
“আজ্ঞে, খুবই চিন্তার কথা। তা মশাই, আপনিও কি ওই বাক্সের একজন উমেদার নাকি?”
বুড়ো মানুষটি দাড়িতে হাত বুলিয়ে একটু হেসে বলল, “না হে বাপু, এই একটু খোঁজখবর নিচ্ছিলাম আর কী! তবে আমি যতদূর জানি, ওই বাক্সের একজন ওয়ারিশান আছে।”
“বুঝেছি, কিন্তু ওয়ারিশান ও বাক্স বেচলেও তো তাতে বিশেষ কিছু পাবে না। কেন এত দাবিদার জুটছে, তা কি বলতে পারেন? মনে হচ্ছে আপনিও বাক্সটার খোঁজেই এসেছেন।”
“তোমার খোঁজেও। তুমি বেশ ভাল লোক।” “ওকথা কবেন না কর্তা, শুনলে পাপ হয়।”
৪. লোকে মন্টুরামের টাকাপয়সা দ্যাখে
লোকে মন্টুরামের টাকাপয়সা দ্যাখে, জমিজিরেত দ্যাখে, মন্টুরামের গাড়ি বাড়ি দ্যাখে। দ্যাখে আর হিংসে করে, আর হিংসেয় জ্বলে-পুড়ে খাক হয়। তারা পাঁচজনের কাছে মন্টুরামের কুচ্ছো গেয়ে বেড়ায়। মন্টুরামের কোনও বিপদআপদ ঘটলে, মন্টুরাম কোনও ফ্যাসাদে পড়লে লোকে ভারী খুশি হয়। এ সবই মন্টুরাম হাড়ে হাড়ে জানেন। কিন্তু লোকে মন্টুরামের দুঃখ বুঝতে চায় না। মন্টুরাম যে কত দুঃখী, তাঁর ধন-দৌলতের তলা দিয়ে দুঃখের ফয়ু নদী বয়ে যাচ্ছে, এ তো আর লোকের চোখে পড়ে না। বুকের দুঃখ বুকে চেপে রেখেই মন্টুরাম নীরবে বিষয়কৰ্ম করে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে এক-আধটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বটে, কিন্তু কর্তব্যকর্মে তিনি সর্বদাই অটল।
পুরনো দুঃখগুলোর সঙ্গে মন্টুরামের একরকম ভাবসাব হয়েই গিয়েছে। দুঃখ নিয়েই যখন থাকতে হবে, দুঃখের সঙ্গেই যখন বসবাস, তখন তাদের সঙ্গে ঝগড়া করে আর লাভ কী? দুঃখ বলতে তাঁর অনেক দিনের ইচ্ছে চৈতন্যপুরের পুরনো রাজবাড়িটা কিনে সেখানে একটা প্রাসাদ বানানো। রাজবাড়িতে থাকার কেতাই আলাদা। তা সেটা হয়ে উঠছে না। কারণ, বুড়ো রাজা হরিশ্চন্দ্র এখনও বেঁচেবর্তে আছেন। আর-একটা দুঃখ হচ্ছে তাঁর বউ হরিমতী। হরিমতীর বড় দানধ্যানের হাত। ভিখিরি আসুক, সাধুসন্নিসি আসুক, চাঁদা পার্টি আসুক, হরিমতী কাউকে ফেরান না। এমনকী, প্রায় প্রতিদিনই দু-চারজন গরিব দুঃখীকে পাত পেড়ে বসে খাওয়ান। অনেক চেষ্টা করেও এই অপচয় ঠেকাতে পারছেন না মন্টুরাম। তাঁর তিন নম্বর দুঃখ হল, ইংরেজি। কিছুদিন আগে গাঁয়ের পুরনো মন্দিরের ফোটো তুলতে একজন রাঙামুলো টকটকে সাহেব এসে হাজির। কিন্তু কেউই তার কথা বুঝতে না পেরে হাঁ করে চেয়ে থাকে। তখন চৈতন্যপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের হেডস্যার অখিলবাবু এগিয়ে গিয়ে সাহেবের সঙ্গে ফটাফট ইংরেজি বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ওইরকম ইংরেজি বলতে না পারার দুঃখে ভারী কাতর হয়ে রয়েছেন মন্টুরাম। তা ইংরেজি শেখার জন্য অখিলবাবুকে মাইনে দিয়ে বহালও করা আছে। কিন্তু বিষয়কর্মে কোনও ফাঁক নেই বলে ফুরসতই হয়ে উঠল না আজ পর্যন্ত মন্টুরামের। এসব ছাড়াও হিসেব করতে বসলে দুঃখের ঝুড়ি ভরে যাবে।