“কেন মশাই, এত মানুষ থাকতে হঠাৎ চামসে গন্ধওলা লোককেই সবাই খুঁজছে কেন?”
“সেটাই তো লাখ টাকার প্রশ্ন হে। শুধু কি খুঁজছে? টাকার থলি হাতে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পেলেই আগাম ধরিয়ে দিয়ে কাজে লাগিয়ে দেবে। তবে কী জানো, যার ওই গন্ধ আছে, সে নিজেও টের পায় কিনা। এই যেমন তুমি। এত গুণ নিয়ে ভরদুপুরে বটতলায় গামছা পেতে শুয়ে আছ। একেই বলে প্রতিভার অপচয়। ক্ষমতার অপব্যবহার, বেনারসি পরে বাসন মাজা।”
সুধীর হাঁ হয়ে লোকটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর খানিকটা বাতাস খেয়ে ফেলে বলল, “আপনি কি বলতে চান যে, আমি একজন ভাল চোর?”
লোকটা ঘনঘন ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলে, “নানা, গন্ধওলা চোরকে আমরা ভাল চোর মোটেই বলি না।”
সুধীর কুঁসে উঠে বলে, “ভালই যদি না হবে, তা হলে এত কথা হচ্ছে কীসের মশাই?”
“শাস্ত্রে গন্ধওলা চোরকে বলে চূড়ামণি চোর। তারা তস্করশ্রেষ্ঠ। তারা হল গে পরস্পাপহরক কুলের রাজা। দশ-বিশ বছরে এরকম মানুষ একটা-দুটো মাত্র জন্মায়। শুধু ভাল চোর বললে যে তাদের বেজায় অপমান হয় হে!”
কথাটা শুনে সুধীর থম ধরে কিছুক্ষণ বসে রইল। স্বপ্ন দেখছে কি, তা কিছুক্ষণ বুঝতে পারল না।
লোকটার চোখ এড়িয়ে নিজের বা বগলটা একটু তুলে গন্ধ শোকারও একটা চেষ্টা করল সে। কিন্তু তেমন কোনও চামসে গন্ধ আছে বলে মনে হল না তার।
লোকটা ভারী উদাস আর করুণ গলায় বলল, “নিজের গায়ের গন্ধ টের পায় না বলে এমন কত প্রতিভাই যে চর্চার অভাবে মাটি হয়ে গেল, তার হিসেব নেই। যার শ্রেষ্ঠ চোর হয়ে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা সে হয়তো দেখা গেল, থানার সেপাই হয়ে টুলে বসে খইনি ডলছে, কিংবা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার হয়ে ছাত্র ঠ্যাঙাচ্ছে, নয়তো বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মীপুজো করে গামছায় চালকলা বেঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরছে কিংবা বটতলায় বসে তোলা উনুনে ভেজাল তেলে ফুলুরি বেগুনি ভাজছে। ভাবলেও মনটা হাহাকারে ভরে যায় হে। বটগাছের বীজ থেকে আসশ্যাওড়া জন্মালে কার না দুঃখ হয় বলো।”
সুধীর উদাস নয়নে দুরের মাঠঘাটের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলল, “না মশাই, অনেক ভেবে দেখেছি, চুরি করা মোটেই ভাল কাজ নয়। ওতে বড় পাপ হয়। ও আমি ছেড়েই দিয়েছি।”
লোকটা ভারী মোলায়েম গলায় বলে, “কথাটা আমিও শুনেছি বটে। চুরি করা মহাপাপ। তা এ হল বহু পুরনো কথা। সাহেব আমলের টানাপাখা কি এখন চলে, বলো! না কি আমরা এখনও সেই আগেকার মানুষের মতো কাঁচা মাংস খাই! বন্দুক পিস্তলের যুগে কেউ কি আজ তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতে নামে! অর্থশাস্ত্রটা পড়ে দ্যাখো বাপু, চুরি করা একরকম সমাজসেবা বই নয়। ধরো না কেন, তুমি একজন পয়সাওলা লোকের কাছ থেকে একশো টাকা চুরি করলে, তারপর সেই একশো টাকা থেকে দু’টাকার মুড়ি-বাতাসা কিনে খেলে, এক টাকার বিড়ি কিনলে, দু’ কিলো চাল, এক পো ডাল, এক শিশি তেল, নুন, লঙ্কা, আখের গুড়, কিনলে তো! তাতে মুড়িওলা, বাতাসাওলা, বিড়িওয়ালা, সবজিওয়ালা সবাই কিছু কিছু পেল। এখন দ্যাখো, যার একশো টাকা ছিল সে একটু নামল, আর মুড়িওলা, বাতাসাওয়ালা, বিড়িওয়ালা, সবজিওলারা একটু উঠল। আর এইভাবে অল্প অল্প করে চোরেরা সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে সাহায্য করছে কি না তা ভেবে দ্যাখো। মানুষ বিপ্লব করে যা করতে চাইছে, চোরেরা তো সেটাই করছে রে বাপু। প্রাণ হাতে করে, রাত জেগে, পুলিশের কিল-গুঁতো খেয়ে, জেল খেটে তারা যা করছে, একদিন লোকে তার মূল্য বুঝবে আর ধন্যি ধন্যি করবে।”
সুধীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “চোরের যে এত মহিমা, চোর যে আসলে বিপ্লবী, তা মোটেই জানতাম না মশাই।”
লোকটা একটু অবাক হয়ে বলল, “কথাটা কি তোমার ন্যায্য মনে হল না বাপু?”
সুধীর ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলে, “অন্যায্যও নয়। তবে কিনা কথাটার মধ্যে কোথায় যেন একটা পাঁচ আছে। সেইটে ধরতে পারছি না।”
“ওরে বাপু, পাঁচ না থাকলে লাটু ঘোরে না, পাঁচ ছাড়া জিলিপি হয় না, ঘুড়ি কাটে না, লতা গাছ বেয়ে উঠতে পারে না। পাঁচ কি ফ্যালনা জিনিস?”
“তা অবিশ্যি ঠিক।” লোকটা খুশি হয়ে বলল, “এই তো বুঝেছ! বুঝতেই হবে। তুমি শুধু গন্ধওলা মানুষই নও, তার উপর নাটা। যত নাটা, তত বুদ্ধি। সাইজটাও একেবারে জুতসই। যাকে বলে সোনায় সোহাগা। মাথায় ফুলঝুরির মতো বুদ্ধি, হাতে কেউটের ছোবলের মতো কাজ, পায়ে হরিণের মতো দৌড়। আর চাইবে কী বাপু, ভগবান তো তোমাকে একেবারে বরপুত্র করেই পাঠিয়েছেন!”
সুধীরের কেন যেন একটু ঠ্যাং দোলাতে ইচ্ছে যাচ্ছিল, তাই সে কিছুক্ষণ নীরবে ঠ্যাং দোলাল।
সাদা দাড়ি-গোঁফ আর সাদা বাবরি চুলের বুড়ো লোকটা তাকে কিছুক্ষণ জুলজুল করে দেখে জামার ভিতরের পকেট থেকে সাবধানে কিছু টাকা বের করে বলল, “দ্যাখো বাপু, গুণী মানুষের কদর করতে পারি, তেমন সাধ্যি আমার নেই। তবু এই হাজার দেড়েক টাকা রাখো।”
সুধীর ভারী অবাক হয়ে মাথা নিচু করে লাজুক গলায় বলল, “আহা, টাকা কীসের জন্য? আমি তো কিছু করিনি এখনও।”।
“তাতে কী? তোমার সময়টা যে ভাল যাচ্ছে না, তা তোমার মুখ দেখেই বুঝেছি।”
সুধীর গদগদ হয়ে বলে, “বড় উপকার করলেন মশাই। অনেক ধারকর্জ হয়ে আছে। সেগুলো শোধ হয়ে যাবে।”