- বইয়ের নামঃ মদন তপাদারের বাক্স
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. জমির দলিলটা
মদন তপাদারের বাক্স – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
জমির দলিলটা বের করবেন বলে দুপুরবেলা মন্টুরামবাবু তাঁর দোতলার শোয়ার ঘরের মস্ত কাঠের আলমারিটা খুলতেই ভিতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে একটা লোক বেরিয়ে এল। মন্টুরামবাবু তো হাঁ। এই পুরনো আর পেল্লায় আলমারিটা তাঁর ঠাকুরদার আমলের জিনিস। এর আগে কখনও তিনি আলমারি থেকে মানুষ বেরোতে দেখেননি। বছর খানেক আগে একবার একটা ইঁদুর বেরিয়েছিল বটে! আর এক-আধবার আরশোলা। কিন্তু মানুষ কখনও বেরোয়নি। তাই তিনি ভারী তাজ্জব হয়ে লোকটাকে দেখছিলেন।
লোকটা ভারী বেঁটেখাটো। সাড়ে চার ফুটের এদিক-ওদিক হবে, রোগাভোগা চেহারা। পরনে আঁট করে মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি, গায়ে একটা কালচে রঙের পিরান আর গলায় মাফলারের মতো জড়ানো একটা লাল গামছা। বেরিয়েই লোকটা হাত-পা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “আর একটু হলেই তো খুনের মামলায় পড়ে যেতেন মশাই!”।
মন্টুরাম এখনও ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা সামলে উঠতে পারেননি। কথাটা শুনে ভড়কে গিয়ে বললেন, “খুনের মামলা! বলো কী হে? হঠাৎ খুনের মামলায় পড়তে যাব কেন?”
“এই যে বারো ঘণ্টার উপর আমাকে আলমারির মধ্যে আটকে রাখলেন, তাতে তো এতক্ষণে আমার মরে কাঠ হয়ে যাওয়ার কথা। প্রাণায়াম-টানায়াম করা ছিল বলে প্রাণটা এখনও দেহ ছেড়ে বেরোয়নি। কিন্তু খিদে-তেষ্টা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি! আগে একটু ঠান্ডা জল আর গরম দুধের ব্যবস্থা করুন দিকি। তারপর যা হোক চাট্টি মাছের ঝোল-ভাত হলেই চলবে। গায়ে মোটে জোরই পাচ্ছি না মশাই।”
মন্টুরামবাবুর মাথাটা এখনও পরিষ্কার হয়নি। তিনি বললেন, “রোসো বাপু, আমার মাথার ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা এখনও যায়নি। ব্যাপারটা আমাকে ধীরেসুস্থে বুঝতে দাও।”
লোকটা উবু হয়ে বসে ধুতির খুঁটে মুখ মুছে বলল, “তবে তো মুশকিলেই ফেললেন মশাই৷ খুনের মামলা থেকে বেঁচে গিয়ে কি শেষে ব্রহ্মহত্যার পাপে পড়বেন? খিদে-তেষ্টায় যে আমার প্রাণ যায়!”
“ব্রহ্মহত্যা! তুমি কি ব্রাহ্মণ নাকি?”
“তা ধরুন একরকম তাই। ব্রহ্ম কার ভিতরে নেই বলুন। ঝালে, ঝোলে, অম্বলে সর্বত্র রয়েছেন।”
“দাঁড়াও বাপু, আমার মাথাটা আরও গুলিয়ে দিয়ো না। আগে ব্যাপারটা বুঝতে দাও। আলমারি থেকে আস্ত একটা জ্যান্ত মানুষ বেরিয়ে এলে কার মাথার ঠিক থাকে বলো তো?”
লোকটা জুলজুলে চোখে মন্টুরামবাবুর দিকে চেয়ে বলল, “আজ্ঞে, সেই কথাটাই তো বলতে চাইছি। আলমারি থেকে জ্যান্ত বেরোলুম বলেই তো জোর বেঁচে গেলেন মশাই। ধরুন, যদি আমার বদলে আমার লাশ বেরোত, তা হলে যাবজ্জীবন না হয় তো ফাঁসি যে বাঁধা ছিল আপনার।”
মন্টুরামবাবু মিটমিট করে লোকটার আগাপাশতলা দেখে নিয়ে বললেন, “তুমি বেশ ঘোড়েল লোক দেখছি। আমার ঘরে ঢুকে আমারই আলমারির মধ্যে সেঁধিয়ে বসে রইলে, ফের আমাকেই ফাঁসির ভয় দেখাচ্ছ! তা বাপু, অত কথায় কাজ নেই। কানাই দারোগাকে খবর পাঠাচ্ছি, সে-ই এসে বুঝুক কার যাবজ্জীবন আর কার ফাঁসি হওয়া উচিত।”
এ কথায় লোকটা ভারী ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে উঠল, “আজ্ঞে, দু’জন ভদ্রলোকের মধ্যে ভাল-মন্দ দুটো কথা হচ্ছে, তার মধ্যে দারোগা-পুলিশ এনে ফেলা কি ঠিক হবে বাবু?”
মন্টুরামবাবু একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, “ওহে বাপু, দারোগা-পুলিশ তো পরের কথা, তার আগে এ বাড়ির লোকেরাই কি ছেড়ে কথা কইবে বলে ভেবেছ? আমার তিন ভাই, সাত ভাইপো আর দুই ভাগনে রয়েছে যে, তারা সবাই বেজায় চড়া মেজাজের লোক। তাদের হাতে উত্তমমধ্যম খেয়ে যদি বা বেঁচে যাও, তারপরে আছে গাঁয়ের লোকের হাটুরে কিল। তারপরও কানাই দারোগার জন্য যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, তবে না?”
লোকটা দেওয়ালঘড়ির দিকে চেয়ে হঠাৎ শশব্যস্তে বলে উঠল, “ইস, বেলা বারোটা বাজে! কথায় কথায় বড্ড দেরি হয়ে গেল কর্তা। বাড়ির সবাই ভাবছে। তা হলে…।”
“আহা, ব্যস্ত হওয়ার কী আছে? আলাপ-পরিচয় হল না, দুটো ভালমন্দ কথা হল না, হুট করে চলে গেলেই কি হয়? বলি, নাম কী তোমার?”
লোকটা হাল ছেড়ে দিয়ে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আজ্ঞে, সুধীর গায়েন নামটা কি চলবে?”
মন্টুরামবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “খুব চলবে। না চলার কী আছে? আমার মন্টুরাম নাম যদি চলে গিয়ে থাকে, তা হলে তো সেই তুলনায় সুধীর দিব্যি নাম।”
“যে আজ্ঞে, সবাই তাই বলে বটে, সুধীর নামটা নাকি বড্ডই ভাল। বেশ ঠান্ডা, সুস্থির নাম। এখন আপনার পছন্দ হলেই হল।”
“না না, নাম আমার পছন্দই হয়েছে হে। তবে কিনা কানাই দারোগার পছন্দ হলেই হয়।”
সুধীর একগাল হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তা হলে কথাবার্তা
তো সব হয়েই গেল, এবার বরং রওনা হয়ে পড়ি! রোদটা এর পর বড় চড়ে যাবে, পথও তো কম নয়!”
“বাপু সুধীর, এ বাড়িতে ঢোকা যত সহজ, বেরোনো তত সোজা নয়।”
সুধীর আঁশটে মুখে বলে, “ঢোকাটাও যে খুব সহজে হয়েছে, তা মোটেই নয়। প্রথমে দু-দুটো সড়ালে কুকুর!”
“হ্যাঁ-হ্যাঁ, বাঘা আর হালুম।”
“তারপর একটা রাক্ষসের মতো চেহারার পাহারাদার।”