“বলতেই হবে।”
হারানচন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “রাস্তায় হঠাৎ গর্ডন সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। গর্ডন তো যন্ত্রপাতি নিয়েই থাকে সারাদিন। ঘড়িটা একটু ফাস্ট যাচ্ছিল বলে তাকে দেখালাম। গর্ডন বলল, সারিয়ে দেবে। তাই তাকে দিয়েছি সারাতে।”
গর্ডন সাহেবের উল্লেখে তিন ভাইবোনের মুখ শুকিয়ে গেল। গর্ডন সাহেবকে ভয় পায় না এমন লোক এই অঞ্চলে কমই আছে। বিশেষ করে বাচ্চারা। তা বলে গর্ডন যে তোক খারাপ তা নয়। বয়স প্রায় হারানচন্দ্রের মতোই হবে। ধবধবে সাদা দাড়ি। ধবধবে সাদা গায়ের রং। খাঁটি সাহেব। সেই ইংরেজ আমল থেকেই এখানে আছে। তার বাপ-মাও এখানেই ছিলেন। মরার পর তাঁদের এখানকারই কবরখানায় কবর দেওয়া হয়। গর্ডন আর দেশে ফিরে যায়নি। তার বাপের বিরাট ব্যবসা ছিল কলকাতায়। ছেলের জন্য বিশাল একখানা বাড়ি, প্রচুর টাকা আর কোম্পানির শেয়ার রেখে গেছেন। তাতে গর্ডনের ভালই চলে যায়। থাকার মধ্যে আছে এক বুড়ি পিসি। ভারী খিটখিটে আর ঝগড়ুটে বলে বুড়িকেও সবাই ভয় খায়। গর্ডন সাহেবের নানা বাতিক। এক গাদা ভয়ংকর চেহারার কুকুর আছে তার। নানারকম যন্ত্রপাতি তৈরি করার জন্য সে একটা বড়সড় ওয়ার্কশপ বানিয়েছে নিজের বাড়িতে। দিনরাত সেখানে খুটখাট দমাস-দুম শব্দ হয়। কখনও হঠাৎ গলগল করে হলুদ ধোঁয়া বেরোয় তার ওয়ার্কশপ থেকে। কখনও বা বিটকেল সব রাসায়নিকের গন্ধে বাতাস ভরে যায়। মাঝরাত্তিরে হঠাৎ হয়তো নীল আগুনের শিখা ওঠে আকাশে। প্রথম প্রথম এসব দেখে বিপদ ঘটেছে ভেবে মানুষ ছুটে যেত। এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। তবে গর্ডন সাহেবের এসব কাণ্ড দেখে সকলেই তাকে এড়িয়ে চলে। একসময়ে শোনা গিয়েছিল গর্ডন সাহেব একটা উড়ুক্কু মোটর সাইকেল তৈরি করছে। আর একবার রটে গেল, গর্ডন একটা কলের মানুষ তৈরি করেছে এবং সেই কল-মানুষ জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ অবধি সব করতে পারে। আর একবার গুজব শোনা গেল, গর্ডন এমন একটা হাওয়া কল তৈরি করেছে যা দিয়ে ইচ্ছেমতো ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি করা যায়। এগুলো সত্যি না মিথ্যে তা কেউ জানে না, কিন্তু নানারকম রটনার ফলে সকলেই গর্ডনকে একটু সমঝে চলে।
গর্ডন খুব লম্বাচওড়া আর গম্ভীর মানুষ। বড় একটা হাসেটাসে। হাতে থাকে গাটওয়ালা একটা মোটা লাঠি। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। চামড়ার ফিতেয় বাঁধা তিন-চারটে বিকট কুকুর নিয়ে যখন সে রাস্তায় বেরোয়, তখন বাচ্চারা তরাসে গিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে সেঁধোয়। গর্ডনের বাগানে আম জাম পেয়ারা কিছু কম নেই। কিন্তু ভয়ে কেউ সেই বাগানের ধারেকাছে যায় না। এক ভয় কুকুরের, আর এক ভয় মাটির নীচেকার চোরা কুঠুরির। মায়েরা দুই বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য চিরকাল বলে এসেছে, গর্ডন সাহেব এসে ধরে নিয়ে গিয়ে পাতালঘরে কুলুপ এঁটে রাখবে।
তাই দাদুর কাছে গর্ডনের কথা শুনে ছানু কদম আর লাটুরও মুখ শুকিয়ে গেল। কথাটা মিথ্যে নাও হতে পারে। কারণ গর্ডন বাস্তবিকই নানারকম যন্ত্রবিদ্যা জানে। দাদুর সঙ্গে তার ভাব প্রায় সেই ছেলেবেলা থেকেই।
তিন ভাইবোন আবার বাগানে গিয়ে মিটিঙে বসল।
ছানু বলল, “দাদু গর্ডন সাহেবের কথা বলে ঘড়ি হারানোর ব্যাপারটা চাপা দিতে চাইছে।”
কদম বলল, “আমারও তাই মনে হয়।”
লাটু মাথা নেড়ে বলল, “মোটেই নয়। ঘড়িটা একটু বিটকেল দেখতে তো ছিলই। বাবাকে ঠকিয়ে কেউ ঘড়িটা গছিয়ে দিয়েছে। বিটকেল ঘড়ি গর্ডন সাহেব ছাড়া আর কে সারাবে? দাদু ঠিক কাজই করেছে।”
কদম বলে বসল, “তুই তো দাদুর ল্যাংবোট।”
ছানু বলল, “একদম ল্যাংবোট। দাদু যেদিকে, তুই-ও সেদিকে। দাদু যদি সত্যি কথাই বলে থাকে, তবে সেই শিং আর লেজওয়ালা বেঁটে লোক, থাবাওয়ালা লম্বা লোকের গল্পও সত্যি।”
লাটু খেঁকিয়ে উঠে বলে, “সত্যি নয় তো শুনে ভয় পাচ্ছিলি কেন?”
ছানুও সমান তেজে বলল, “তুইও তো দাদুর মতো ভূত মানিস না, ভগবান মানিস না, তাহলে রাতে একা ঘরে শুতে আর বাথরুমে যেতে ভয় পাস কেন? আর কেনই বা পরীক্ষার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে সরস্বতীর ছবি প্রণাম করে যাস?”
এইরকম যখন তিন ভাইবোনে তর্ক চলছে, সেই সময় নিত্য দাস “জয় কালী কলকাত্তাওয়ালি! জয় শিবশম্ভো! জয় করালবদনী!” বলে এসে ফটকে দাঁড়াল। শুনে তিন ভাইবোনে। তো থ! কারণ নিত্য দাস পরম বৈষ্ণব। শাক্তদের সে মোটেই পছন্দ করে না। যেমন জটাইদাদু রাধা বা কৃষ্ণের নাম শুনলে তেড়ে মারতে আসেন তেমনি, নিত্য দাস কালীর নাম শুনলে জিব কাটে। সেই নিত্য দাসের মুখে কালীর জয়ধ্বনি শুনলে কে না মূর্ছা যাবে?
তিনজনে দৌড়ে গিয়ে নিত্য দাসকে ঘিরে ধরল। লাটু বলল, “তুমি কালীর নাম নিচ্ছ, ব্যাপার কী গো নিত্যদা?”
নিত্য দাস মাথা নেড়ে বলল, “কালীর নাম নেব না তো কার নাম নেব? কালীই আসল?”
“তুমি না বোষ্টম!”
“সে ছিলাম আজ সকাল অবধি। জটাইবাবার যা মহিমা দেখলাম, তাতে মনে হল, ছ্যা ছ্যা, এতকাল করেছি কী? তন্ত্রসাধনার মতো জিনিস আছে? আজ সকাল থেকে আমি তান্ত্রিক হয়ে গেছি।”
“কী দেখলে বলল না!” বলে কদম নিত্য দাসের কাপড়জামা টানাহ্যাঁচড়া শুরু করে দিল।
“ওঃ, সে যা দেখলাম দিদি, বলার নয়। চারদিকে যেন ভূতের বৃষ্টি। লম্বা ভূত, বেঁটে ভূত, চালাক ভূত, গানদার ভূত একেবারে গিজগিজ করছে বাবার থানে।”