“তাতে দোষটা কী হল?” লাটু বুক চিতিয়ে প্রশ্ন করে।
“ধবলী যদি গিলেই থাকে তবে পরদিন তার গোবর ঘেঁটে ঘড়িটা আমরা পেলাম না কেন?”
“ঘড়িটা হয়তো ও হজম করে ফেলেছে।”
“ঘড়ি কখনও হজম হয়? মোটেই জাবনার সঙ্গে ঘড়ি মিশে যায়নি।”
লাটু বিপন্ন হয়ে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা। অত পুরনো কথায় কাজ কী? এ ঘড়িটা নিয়ে মিটিং ডাকা হয়েছে, এটা নিয়েই কথা হোক।”
“কথা হোক।”
“কথা থোক।”
লাটু বলল, “ঘড়িটা আমরা খুঁজব। প্রথমে আমরা দাদুর কাছে গিয়ে নানারকম প্রশ্ন করে জেনে নেব ঠিক কী কী সকালবেলায় ঘটেছে।”
কদম বলল, “কী লাভ? দাদু তো সত্যি কথা বলবে না।”
ছানু বলল, “শুধু তাই নয়, দাদু অনেক কিছু বানিয়ে বলে আমাদের কাজ আরও জটিল করে তুলবে।”
লাটু চোখ কটমট করে তাকিয়ে বলল, “তাহলে তোমরা বলতে চাও যে, আমাদের দাদু একজন মিথ্যেবাদী?”
ছানু বলল,”মোটেই নয়।”
কদম বলে, “আমরা বলতে চাই আমাদের দাদু ঘড়ি হারানোর ব্যাপার ছাড়া অন্য সব বিষয়েই সত্যবাদী।”
ছানু যোগ করে বলল, “শুধু ঘড়ি নয়। দাদু আরও কিছু কিছু জিনিস হারান। যেমন, চটিজুতো, বাঁধানো দাঁত, চশমা, লাঠি, পয়সা…”
লাটু বাধা দিয়ে বলল, “অন্য সব কথা থাক। আমরা শুধু একটা বিষয়েই আজ আলোচনা করব।”
এইভাবে অনেক তর্কবিতর্কের পর একটা কাগজে কয়েকটা প্রশ্ন লেখা হল। দাদুকে এই প্রশ্ন করা হবে। কিন্তু এমনভাবে করা হবে যাতে দাদু বুঝতে না পারেন যে, তাঁকে জেরা করা হচ্ছে।
লাটু পরামর্শ দিল, “মাথা চুলকোলে দাদু খুব আরাম পায়। অতএব আমি যখন দাদুকে জেরা করব তখন কদম তাঁর মাথা চুলকোবে। আর ছানু, তুই দাদুর পায়ের আঙুলগুলো টেনে দিবি।”
এসব পরামর্শ শেষ করে তিন ভাইবোনে উঠল। দিবানিদ্রার পর হারানচন্দ্র বিষণ্ণ মুখে দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ার পেতে বসে ছিলেন। মনটা খুবই খারাপ। তাঁকে এ বাড়ির কেউ বিশ্বাস করে না। তা ছাড়া তিনি কস্মিনকালেও ভূত প্রেত ঈশ্বর কিছুই মানেননি। কিন্তু এখন ঠেকায় পড়ে সব কিছুকেই একরকম স্বীকার করে ফেলতে হবে হয়তো। এটাকে
তিনি একটা হেরে-যাওয়া বলে মনে করেন। ভূতকেই যদি মানেন তবে ঈশ্বরকে মানতেও দেরি হবে না। ওই যে কী একটা কথা আছে না, ইফ উইনটার কাস ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড?
খুব আনমনে বসে ছিলেন হারানচন্দ্র। হঠাৎ তিন নাতি-নাতনি এসে হাসি হাসি মুখে তিনদিকে দাঁড়াল।
“দাদু, তোমার মাথা চুলকে দেব?”
“দাদু, তোমার পায়ের আঙুল টেনে দিই?”
তিনজনই বিচ্ছু। তার মধ্যে লাটুটা তাঁর ন্যাওটা। হারানচন্দ্র একটু সন্দেহের চোখে ওদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “তা দে।”
কদম আর ছানু দাদুর সেবায় লেগে গেল। হারানচন্দ্র ভারী আরাম পেয়ে চোখ বুজে ফেললেন। ঘুম-ঘুম ভাব।
লাটু খুব মিঠে গলায় ডাকল, “দাদু!”
“আজ সকালে তুমি কি উত্তরদিকে বেড়াতে গিয়েছিলে?”
“উত্তরদিক! তা হবে বোধহয়।”
“ঠিক করে বলো।”
“কেন রে? দিক দিয়ে কী করবি?”
“আমাদের একটা বাজি হয়েছে। বলো না।”
“হ্যাঁ। উত্তরদিকেই।”
“বেড়ানোর সময় তোমার সঙ্গে কারও দেখা হয়েছিল?”
“হয়েছিল বোধহয়।”
“বলো না।”
“আঃ, বড্ড জ্বালাচ্ছিস। এখন যা।”
ছানু বলল, “তাহলে কিন্তু পায়ের আঙুল টানব না।“
কদম বলল, “আমিও মাথা চুলকোব না।”
দাদু তিনজনকে আর একবার দেখে বলেন, “মতলবখান কী তোদের? অ্যাঁ!”
“আগে বলো।” লাটু বলে।
হারানচন্দ্র বলেন, “হয়েছিল দেখা।”
“কার সঙ্গে?”
“অনেকের সঙ্গে। সব কি মনে থাকে?”
“মনে করে বলো।”
মাথা চুলকোনো আর পায়ের আঙুল টানার আরামে চোখ বুজে হারানচন্দ্র বললেন, “একটা বেঁটে লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কটা বাজে। তা আমি একটু লক্ষ করে দেখলাম লোকটার মাথায় দুটো শিং আছে।”
কদম বলল, “এঃ, এটা একদম চলবে না দাদু। গুল।”
হারানচন্দ্র হার না মেনে বললেন, “আর একটা ঢ্যাঙা লোকের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। সে সময় জানতে চায়। তা দেখলাম এ লোকটার হাতের চেটো আর পায়ের পাতা অবিকল বাঘের থাবার মতো।”
ছানু আঙুল টানা বন্ধ করে বলল, “ভাল হচ্ছে না কিন্তু দাদু। আমি কিন্তু ভয় পাচ্ছি।”
লাটু হতাশ হয়ে বলে, “এরকম করলে তদন্ত এগোবে কী করে বলো তো?”
হারানচন্দ্র অবাক হয়ে বলেন, “কিসের তদন্ত?”
ছানু বোকার মতো বলে ফেলল, “বাঃ, তোমার ঘড়িটা চুরি গেছে না! আমরা সেটা খুঁজতে বেরোব যে!”
লাটু ছানুর মাথায় একটা গাঁট্টা মেরে বলল, “বললি কেন?”
“তদন্তের কথা তুই-ই তো বলে ফেললি!” ছানু মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে।
হারানচন্দ্র দুজনের মাঝখানে পড়ে বললেন, “বুঝেছি। তোরা ধরে নিয়েছিস যে, ঘড়িটা চুরিই গেছে! কিন্তু বাস্তবিক তা নয়। ঘড়িটা এক জায়গায় আছে। খুব ভালই আছে। সেটা ফেরতও পাওয়া যাবে। চিন্তা নেই।”
লাটু বলল, “কোথায় আছে সেটা আমরা জানতে চাই। ঘড়ির ব্যাপারে তোমার যে বদনাম হয়ে যাচ্ছে তা আর আমরা সহ্য করব না। কাকে দিয়েছ বলো।”
হারানচন্দ্র জটাইয়ের কথাটা বলতে চান না। বললে কোথাকার জল কোথায় দাঁড়াবে কে বলতে পারে। তিনি ভূত ভগবান তন্ত্রমন্ত্র কিছুই মানেন না। এই দুষ্টু নাতি-নাতনিরা যদি জানতে পারে যে, তাঁর ঘড়িতে ভূত ভর করেছে, এবং সেটা শোধন করতে জটাইকে দিয়েছেন, তবে এরা খেপিয়ে মারবে। তিনি একটু চিন্তা করে লাটুর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, “বলতেই হবে?”