কিন্তু এই সময় ভারী বেসুরো গলায় কে যেন খুব কাছ থেকে ধমকের স্বরে বলে ওঠে, “রামরাহা! খ্রাচ খ্রাচ! রামরাহা! রামরাহা! খুচ খুচ!”
“কিছু বলছেন প্রভু?” বলে নিত্য দাস জটাইয়ের দিকে তাকায়।
জটাইও চারদিকে তাকাতে তাকাতে মাথা নেড়ে বললেন, “না। কিন্তু কেউ কিছু বলছে।”
“কী বলছে প্রভু? বড় বিচিত্র ভাষা!”
আচম্বিতে আবার সেই অশরীরী স্বর বলে উঠল, “নানটাং! রিকিরিকি! রামরাহা!”
নিত্য দাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে, “জয় কালী! জয়। কালী।”
জটাই তান্ত্রিক তার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু দুর্বল গলায় বললেন, “কালীর নাম নিলে তাহলে?”
নিত্য দাস অভিমানের চোখে জটাইয়ের দিকে চেয়ে থেকে। বলে, “আমার সঙ্গে ছলনা কেন প্রভু? সবই বুঝতে পেরেছি। একটু পায়ের ধুলো দিন প্রভু। আপনার বাঞ্ছারাম ভূতকে এতকাল বিশ্বাস করিনি। ভাবতাম প্রভু বুঝি গুল দিচ্ছেন। আজ প্রমাণ। পেলাম।”
“বাঞ্ছারাম!” বলে জটাই তান্ত্রিক একটু ভাবিত হয়ে পড়লেন। তারপর হতাশ গলায় বললেন, “তাই হবে।”
“প্রভুর কী মহিমা!” বলে নিত্য দাস কিছুক্ষণ তদগতভাবে চোখ বুজে থেকে বলে, “প্রভুর মহিমায় ভূতের মুখে পর্যন্ত রামনাম শোনা গেল।”
জটাই তান্ত্রিক একটু চমকে উঠে বললেন, “বলছে নাকি?”
“ছলনা কেন প্রভু? স্বকর্ণে শুনেছি, বাঞ্ছারাম বলছে, রামরাহা। রামরাহা।”
“তাই বটে।”
“কিন্তু প্রভু। রামের সঙ্গে ওই রাহা কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আর ওই খুচ খুচ খ্রাচ খ্রাচগুলোরই বা মানে কী? ভুতুড়ে ভাষা নাকি?”
জটাই তান্ত্রিক কাঁচমাচু মুখে বললেন, “তাই হবে বোধহয়।”
এই সময়ে হঠাৎ দু’জনকে চমকে দিয়ে একটা মেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর ভারী সুরেলা গলায় বলতে লাগল, “র্যাড়া ক্যালি! রামরাহা! বুত! বুত!”
নিত্য দাস চোখ বড় বড় করে জটাইয়ের দিকে চেয়ে বলে, “এটি কে প্রভু? বাঞ্ছাসীতা নয় তো!”
“বাঞ্ছাসীতা!” জটাই তান্ত্রিক শুকনো মুখে বলেন, “সে আবার কে?”
“কেন, বাঞ্ছারামের বউ! আহা, ভূতের মুখে এসব শুনলেও প্রাণ ঠাণ্ডা হয়। বলল রাধা কালী রাম ভূত। “
জটাই তান্ত্রিক বে-খেয়ালে বলে উঠলেন, “জয় রাধে! জয় রাধে!” নিত্য দাস মাথা নেড়ে বলে, “ও নাম নেবেন না প্রভু। বোষ্টম ধর্ম কোনও ধর্মই নয়। আজ বুঝলাম তন্ত্রসাধনাই হল আসল সাধনা। জয় কালী! জয় শিবশম্ভো!”। ছলছলে চোখে নিত্য দাস সাষ্টাঙ্গে জটাই তান্ত্রিকের পায়ের ওপর পড়ে পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় আর জিবে ঠেকাল। তারপর মনের ভুলে চা না খেয়েই বিদায় হল।
৪. দুপুরবেলায় ছানু আর কদম
দুপুরবেলায় ছানু আর কদম আর লাটুর মিটিং বসল। দাদুর হারানো ঘড়ি নিয়ে তারা খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
লাটু অসম্ভব দাদুভক্ত। সে বলল, “ঘড়িটার জন্য দাদুকে ঠাকুমার কাছে অপমান হতে হচ্ছে। এটা আমি সহ্য করতে পারছি না। ঘড়িটা খুঁজে বের করতেই হবে।”
ছানু আর কদম একটু ঠাকুমা-ঘেঁষা। ছানু ঠোঁট উল্টে বলল, “খুঁজে বের করে কী লাভ? দাদু তো আবার হারাবে।”
কদমও মাথা নেড়ে বলল, “খুঁজে বের করতে পারলেও ঘড়িটা দাদুকে ফেরত দেওয়া হবে না। ঠাকুমার কাছে থাকবে। দাদু দরকারমতো ঠাকুমার কাছ থেকে কটা বেজেছে জেনে নেবে।”
লাটু বলল, “দাদু কি আর ইচ্ছে করে হারায়। তা ছাড়া এবার হয়তো দাদু ঠিকই বলছে। ঘড়িটা হারায়নি। সারাতেই দেওয়া হয়েছে।”
ছানু বলল, “মোটেই নয়। ঠাকুমার ভয়ে দাদু ওসব বানিয়ে বলছে। মনে নেই এর আগেরবার দাদু বারবার বলছিল যে, ঘড়িটা চুরি যায়নি, চুরি গেছে রেডিওটা!”
কদমও সায় দিয়ে বলে, “ঠিক কথা। ঘড়ির ব্যাপারে দাদু সত্যি কথা কমই বলে। আমার মনে আছে গতবছর নীল ডায়ালের যে ঘড়িটা হারাল, দাদু বলেছিল, সেটা নাকি চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে। আমরা বাচ্চা মানুষরাও জানি যে, চিলে ঘড়ি নেয় না।”
লাটু একটু রেগে গিয়ে বলে, “দাদু মোটেই মিথ্যে কথা বলেনি। জয়গোপালের দোকান থেকে গরম জিলিপি নিয়ে আসছিল দাদু। চিলটা ছোঁ মারে। দাদু জিলিপির ঠোঙা বাঁচাতে হাতচাপা দেয়। চিলটা ঠোঙার বদলে হাত থেকে ঘড়িটা ভুল করে নিয়ে যায়। ভেলভেটের ব্যান্ড ছিল তাই নিতে পেরেছে।”
কদম বলল, “গুল। চিলে ঘড়ি নিলে দাদুর কব্জিতে আঁচড়ের দাগ থাকত।”
ছানু বলল, “সাদা ডায়ালের যে ঘড়িটা তার আগে হারিয়েছিল, সেটাও কিছুতেই ম্যাজিশিয়ান ভ্যানিশ করে দেয়নি। ম্যাজিশিয়ান কিছু ভ্যানিশ করলে তা ফের ফিরিয়েও আনে।”
লাটু বলে, “তোরা সব সময়েই দাদুর দোষ দেখিস। দাদুর দোষটা কী? বাজারের পথে লোকটা ম্যাজিক দেখাচ্ছিল। নানারকম জিনিস হামানদিয়ে গুঁড়ো করে ফের টুপি থেকে আস্ত আস্ত বের করছিল। দাদু তার ঘড়িটা দেয়। ম্যাজিশিয়ান যখন হামানদিস্তায় সব গুঁড়ো করে টুপিটার ঢাকনা খুলতে যাচ্ছে, ঠিক সেইসময়ে বাজারের কয়েকটা দুষ্টু ছেলে শিবের ষাঁড় বিশ্বেশ্বরকে খেপিয়ে দিল যে! বিশ্বেশ্বরের তাড়া খেয়ে সব লোকজন চোঁ-চাঁ দৌড়াল। সেই ম্যাজিশিয়ান কোথায় উধাও হল কে বলবে? দাদু যে কোনওক্রমে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছিল এই ঢের। প্রাণের চেয়ে কি ঘড়ি বেশি?”
কদম হুঁ হুঁ করে মাথা নেড়ে বলে, “তুই বড় দাদুর দিকে টানিস। কালো ডায়ালের ঘড়িটা তাহলে আমাদের গোরু ধবলীই খেয়েছে! দাদু বলেছিল জাবনা মাখতে গিয়ে ঘড়িটা জাবনার সঙ্গে মিশে যায় আর ধবলী নিশ্চয়ই সেটা জাবনার সঙ্গে খেয়ে নিয়েছে। বলেছিল তো?”