জটাই তান্ত্রিকের পোষা ভূত বাঞ্ছারাম ঘুমোয় একটা মেটে হাঁড়ির মধ্যে। বেশি বায়নাক্কা নেই। সন্ধে হলে নিজেই উঠে পড়ে।
জটাই তান্ত্রিক সন্ধে হতেই বাঞ্ছারামের উদ্দেশে একটা হাঁক দেন, “ওরে বাঞ্ছা!”
হাঁড়ির ভিতর থেকে বাঞ্ছারাম সড়ত করে বেরিয়ে আসে।
ভূতের রূপ নিয়েও নানারকম মতভেদ আছে। কেউ বলে, বুড়ো আঙুলের সাইজ, হাত পা নেই, শুধু মুণ্ডু। কেউ বলে, যার ভূত তার মতোই দেখতে হয়। অনেকের মতে ভূত খুব রোগা কালো এবং তাদের পায়ের পাতা থাকে উলটোদিকে।
বাঞ্ছারামের চেহারা কী রকম তা আমরা জানি না। কারণ, একমাত্র জটাই তান্ত্রিক ছাড়া আর কেউ তাকে চোখে দেখেনি। জটাই নিজে কখনও কাউকে বলেননি যে, বাঞ্ছা কীরকম দেখতে।
সন্ধে লাগতে না লাগতেই মেলা বুড়োবুড়ি এবং তাঁদের নাতিপুতিরা জড়ো হয়েছে জটাইয়ের আস্তানায়। এ সময়ে জটাই বিস্তর রুগিকে ওষুধ দেন, ভবিষ্যৎ বলেন, হারানো জিনিসের হদিস বাতলান, ধর্মকথা বলেন। সবাই রোজ বাঞ্ছারামের চেহারাটা দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাপীতাপীর চোখ, তাই দেখতে পান না।
কিন্তু জটাই তান্ত্রিক পান। এমনভাবে শূন্যের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন যেন একেবারে জলজ্যান্ত দেখতে পাচ্ছেন।
জটাই তান্ত্রিক বাঞ্ছারামের দিকে চেয়ে একটা ধমক দিলেন, “বলি হারানের সেই চুরি-যাওয়া ঘড়িটার হদিস করলি?”
বাঞ্ছারামের জবাব শোনা যায় না। কিন্তু সবাই বুঝতে পারে যে, সে আছে।
ক’দিন হল এ তল্লাটে নিত্য দাস নামে এক বৈষ্ণব এসে ঘাঁটি গেড়েছে। বয়স বেশি নয়। বড় জ্বালাচ্ছে। জটাই তান্ত্রিক বৈষ্ণবদের মোটেই সহ্য করতে পারেন না। তুলসীর মালা, তিলক, কোলকুঁজো বিনয়ী ভাব, অমায়িক হাসি, মিঠি-মিঠি কথা, এসব তাঁর ভারী মেয়েলিপনা মনে হয়। হ্যাঁ, পুরুষের সাধনা বললে বলতে হয় তন্ত্রকে। শবের ওপর বসে মাঝরাতে সাধনা, ভূতপ্রেত নিয়ে কারবার, করোটিতে কারণ পান, বৈষ্ণবদের দুর্বল কলজে এসব সহ্যই করতে পারবে না।
কিন্তু নিত্য দাস লোকটা অতি ঘড়েল। সকালবেলাতেই সে মাধুকরীতে বেরোয়। অর্থাৎ সোজা কথায় ভিক্ষে, ভিক্ষে জিনিসটা দু চোখে দেখতে পারেন না জটাই তান্ত্রিক। যাতায়াতের পথে নিত্য আজকাল রোজই জটাই তান্ত্রিকের আস্তানায় হানা দেয়। মিহি সুরে বলে, “জয় নিতাই, জয় রাধামাধব, জয় মহাপ্রভু।”
জটাই তান্ত্রিকও জলদ-গম্ভীর স্বরে হুহুংকার দিয়ে ওঠেন, “জ্জয় কালী। জ্জয় কালী। জ্জয় শিবশম্ভো। ববম বম।”
এই হুংকারে বহু মানুষ ভিরমি খেয়েছে। কিন্তু নিত্য দাস সেই পাত্র নয়। বিনয়ে গলে পড়ে কান-এঁটো করা হাসি হেসে জোড়হাতে সে রোজ বলে, “কৃষ্ণের দয়া হোক, রাধারানীর দয়া হোক, মহাপ্রভুর দয়া হোক। রাধা আর কালী কি আলাদা রে মন? প্রভু কৃষ্ণ যে, সেই না শিব! পেন্নাম হই প্রভু, একটু চা প্রসাদ হবে না ঠাকুর?”
জটাই লোকটাকে দেখতে পারেন না বটে, কিন্তু তাড়াতেও পারেন না। নিত্য দাসের ধূর্ত চোখ দেখেই বোঝেন, হেঁটো মেঠো লোক নয়। এলেম আছে। লোক চরিয়ে খায়। জটাই তাই বেজার মুখে বলেন, “হবে চা। বসে যাও।”
চা খেতে খেতে রোজই দুজনের কিছু কথাবার্তা হয়। “বলি ওহে বৈষ্ণব, আর কতদূর?”
“অনেক দূর বাবা, এখনও অনেক দূর। রাধারানীর মায়া। যে কলের মধ্যে ফেলে রেখেছেন, সেখানকার বন্ধন কি সহজে কাটে প্রভু?”
“তৈরি লোক দেখছি। বলি ভিক্ষে-সিক্ষে জুটছে কেমন?”
“আজ্ঞে প্রভুর দয়া। জোটে কিছু।”
“তা এদিকেই ডেরা করবে নাকি?”
“রাধারানীর ইচ্ছে প্রভু।”
জটাই তান্ত্রিক বোঝেন যে, নিত্য দাস এই যে রোজ এসে তাঁর ডেরায় হানা দেয় এর পিছনে কোনও মতলব আছে। কিন্তু কী মতলব, তা জটাই অনেক ভেবেও বের করতে পারেননি।
হারান ঘড়িটা রেখে গেছে। জটাই তান্ত্রিক একটু নেড়েচেড়ে দেখলেন। ঘড়িটা একটু অদ্ভুত রকমের। ঠিক এরকম ঘড়ি তিনি আগে আর দেখেননি। পৃথিবীতে যে আজকাল কত রকম কল চালু হয়েছে। ছোট্ট একটা নোটবইয়ের আকারের যন্ত্র বেরিয়েছে, ক্যালকুলেটর, তাই দিয়ে চোখের পলকে বড় বড় সব আঁক কষে ফেলা যায়। এমন আরও কত কী!
হারানের ঘড়িটায় চব্বিশটা ঘর আছে। ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটা তো আছেই। তা ছাড়া ডায়ালের ওপর আরও তিনটে ছোট-ছোট ডায়াল এবং সেখানেও দুটো করে কাঁটা ঘুরে যাচ্ছে। জটাই আরও নিবিষ্টভাবে লক্ষ করে দেখতে পেলেন, গোটা ডায়ালটায় ঝাঁঝরির মতো ছিদ্র রয়েছে। কিন্তু এত সূক্ষ্ম যে, খালি চোখে ভাল বোঝা যায় না।
ঘড়িটা যখন খুব নিবিষ্টমনে দেখছেন, তখন খুব কাছ থেকে কে যেন বলে উঠল, “খুচ খুচ। খুচে। রামরাহা।”
জটাই চমকে উঠলেন, হাঁক দিলেন, “কে রে?”
কিন্তু ধারে-কাছে কেউ নেই। দিনের আলোয় চারদিক ফটফট করছে। জটাই বেকুবের মতো চারদিকে তাকাতে লাগলেন।
“জয় রাধে! জয় নিতাই! জয় রাধাগোবিন্দ। ভাল আছেন তো প্রভু?” বলতে বলতে নিত্য দাস এসে হাজির। মুখে বিগলিত হাসি।
জটাই তান্ত্রিক এমন ভড়কে গেছেন যে, ‘জ্জয় কালী’ বলে হাঁক মারতে পর্যন্ত ভুলে গেলেন। মাথা চুলকোতে চুলকোতে মনের ভুলে বলে ফেললেন, “জয় নিতাই, ভাল আছ তো নিত্য দাস?”
নিত্য দাস তান্ত্রিকের মুখে ‘জয় নিতাই শুনে চোখের পলক ফেলতে পর্যন্ত ভুলে গেছে। হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ দুহাত তুলে নাচতে নাচতে বলতে লাগল, “ভূতের মুখে রাম নাম! ভূতের মুখে রাম নাম! জয় নিত্যানন্দ, জয় রাধাগোবিন্দ! জয়…”