“তুমি দেখতে পাচ্ছ?”
“পরিষ্কার। তবে দেখার জন্য আলাদা চোখ চাই।”
“ঘড়িটা কি তাহলে ফেরত দেব?”
জটাই তান্ত্রিক একগাল হেসে বলেন, “আমি থাকতে তুমি ভূতের ভয়ে ঘড়ি ফেরত দেবে? পাগল নাকি! ঘড়িটা আমার কাছে এখন থাক। শোধন করে দিয়ে আসব’খন।”
হারানচন্দ্র সম্মতি প্রকাশ করে উঠে পড়লেন। তারপর বললেন, “ইয়ে, বাড়িতে এ নিয়ে কিছু বোলো না।”
“আরে না। নিশ্চিন্ত থাকো।”
হারানচন্দ্র বিরস মুখে বাড়ি ফিরলেন।
বাড়ি ফিরতেই একটা শোরগোল উঠল। লাটু, কদম আর ছানু এসে দাদুকে একটু দেখে নিয়েই ছুটল ঠাকুমাকে খবর দিতে, “ও ঠাকুমা! দাদুর হাতে ঘড়ি নেই।”
“আবার হারিয়েছ?” বলে হুংকার দিয়ে বাসবনলিনী ধেয়ে এলেন।
ঘড়ি হারায়নি। জটাই তান্ত্রিকের কাছে শোধন করতে দিয়ে এসেছেন। কিন্তু সে কথা স্বীকার করেন কী করে? বাড়ির সবাইকে এতকাল তিনি নিজেই বুঝিয়ে এসেছেন যে, তিনি ঘঘারতর নাস্তিক, তন্ত্রমন্ত্র ঈশ্বর কিছুই মানেন না। হারানচন্দ্র আমতা-আমতা করে বললেন, “হারায়নি। হারাবে কেন?”
“তাহলে ঘড়ি কোথায়?”
“কোথাও আছে এখানে সেখানে।”
“তুমি ঘড়ি হাতে দিয়ে বেরোওনি?”
হারানচন্দ্র ফাঁপরে পড়ে বলেন, “ইয়ে, ঘড়িটা আমি সারাতে দিয়েছি।”
“সারাতে দিয়েছ! নতুন ঘড়ি যে!”
“নতুন নয়। সত্যকে নতুন বলে গছিয়েছে। আসলে সেকেন্ডহ্যান্ড। একটু গোলমাল করছিল।”
“কার কাছে সারাতে দিলে?”
“আমার এক বন্ধুর কাছে।” বলে হারানচন্দ্র একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ছাড়লেন। কথাটা খুব মিথ্যেও বলা হল না। শোধন করা মানে তো একরকম সারানোই।
তবে বাসবনলিনীকে ঠকানো মুশকিল। চোখ বড় বড় করে হারানচন্দ্রের দিকে খানিকক্ষণ রক্ত-জল-করা স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার আবার ঘড়ির মিস্ত্রি বন্ধু কে আছে? সবাইকেই তো চিনি।”
হারানচন্দ্র বিপন্ন হয়ে বলেন, “আছে আছে। সবাইকে তুমি চিনবে কী করে?”
বাসবনলিনী তর্ক করলেন না। আরও কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চাপা স্বরে বললেন, “বুড়ো বয়সে আর কত মিথ্যে কথা বলবে? সত্যি কথাটা বললেই তো হয় যে, ঘড়িটা আবার হারিয়েছ। আনকোরা নতুন ঘড়িটা হারালে, তার ওপর ছেলের বদনাম করে বলে বেড়াচ্ছ যে, ঘড়িটা সেকেন্ডহ্যান্ড ছিল! ছিঃ ছিঃ!”
হারানচন্দ্র মরমে মরে গেলেন। কিন্তু কিছু করারও নেই। কথাটা রাষ্ট্র হতে দেরি হল না। সবাই জানল, হারানচন্দ্র আবার ঘড়ি হারিয়েছেন। হারানচন্দ্র অবশ্য স্বীকার করলেন না। কেবল বলতে লাগলেন, “ঠিক আছে। সারিয়ে আনি আগে, তারপর দেখো।”
হারানচন্দ্রের মেজ ছেলে রজোগুণহরির শখ হল ফোটোগ্রাফির। গোটাকয়েক ক্যামেরা আছে তার। দিনরাত ফোটোগ্রাফি নিয়েই তার যত চিন্তাভাবনা। গোটা গঞ্জের যাবতীয় মানুষের ছবি তার ভোলা হয়ে গেছে। কুকুর, বাঁদর, বেড়াল, পাখি, ফড়িং, পোকামাকড়ও বড় একটা বাদ নেই। প্রতিদিনই সে ছবি তুলছে। নিজেরই একটা ডার্করুম আছে তার। সেখানে ফিল্ম ডেভেলপ আর প্রিন্টিং-এর ব্যবস্থা আছে। নানা পত্রপত্রিকায় সে ছবি পাঠায়। বেশির ভাগই ছাপা হয় না। চাঁদের আলোয় কাশফুল, মেঘের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মুখ, সাপের ব্যাং ধরা, বাঁদরের অপত্যস্নেহ ইত্যাদি অনেক ছবি তুলে গঞ্জে বেশ বিখ্যাত হয়েছে রজোগুণ।
রজোগুণের লাইকা ক্যামেরায় শেষ দু’তিনটে শট বাকি ছিল। তাই আজ খুব ভোরে উঠে সে একটা কাকের ব্রেকফাস্টের ছবি তুলেছে। কাকটা তেতলা ছাদের রেলিঙে বসে এঁটোকাঁটা কিছু খাচ্ছিল। বাবা ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘুমোচ্ছে, হাতে ঘড়ি, এই ছবিটাও তুলে ফেলল সে। বাগানে একটা প্রজাপতির ছবি তুলতেই ফিল্ম শেষ হয়ে গেল।
দুপুর নাগাদ ফিল্ম ডেভেলপ করার পর শেষ তিনটে নেগেটিভ দেখে সে তাজ্জব হয়ে গেল। আশ্চর্য! এ কী! তিনটে ছবির একটাও ওঠেনি। একদম সাদা। এরকম হওয়ার তো কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, দুনম্বর ছবিটা। এটা হারানচন্দ্রের ঘুমন্ত অবস্থার ছবি। এ ছবিতে আর সব সাদা হলেও ঘড়িটার ছবি কিন্তু ঠিকই উঠেছে। রজোগুণের বেশ মনে আছে, তার বাবার বাঁ হাতখানা ছিল পেটের ওপর। ঘড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ভিউ ফাঁইন্ডারে। ছবিতে ঘড়িটা উঠেছে মাঝামাঝি জায়গায়। কিন্তু হারানচন্দ্র বিলকুল গায়েব!
রজোগুণ ক্যামেরাটা ভাল করে পরীক্ষা করল। না, কোনও গোলমাল নেই তো!
রজোগুণ বসে-বসে কাণ্ডটা কী হল তা ভাবছে, এমন সময় বহুগুণ এসে হানা দিল।
“মেজদা, তোমার ঘড়িটা একটু দেবে? আমার ঘড়িটা সকাল থেকেই গোলমাল করছে।”
রজোগুণ অন্যমনস্কভাবে বলল, “টেবিলে আছে, নিয়ে যা।”
বহুগুণ ঘড়িটা নিয়ে একটু দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে, “আরে! তোমারটাও যে উলটো চলছে!”
“তার মানে?”
“সকাল থেকেই আমার ঘড়ির কাঁটা উলটো দিকে ঘুরে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম ঘড়িটা বোধহয় খারাপ হয়েছে। এখন দেখছি তোমারটাও তাই।”
রজোগুণ ঘড়িটা হাতে নিয়ে দেখল। বাস্তবিকই তাই। সেকেণ্ডের কাঁটাটা উলটোদিকে ঘুরে যাচ্ছে। মিনিটের কাঁটাও পাক খাচ্ছে উলটোবাগে।
দু ভাই দু ভাইয়ের দিকে বোকার মতো চেয়ে থাকে।
৩. ভূতেদের নিয়ম
ভূতেদের নিয়ম হল তারা দিনের বেলা ঘুমোয়, রাতের বেলা জাগে। এ ব্যাপারে প্যাঁচা বা বাদুড়ের সঙ্গে তাদের বেশ মিল আছে। অনেকেই বলে থাকে যে, ভূত মাছ-ভাজা খেতে ভালবাসে। কিন্তু সর্বশেষ গবেষণায় জানা গেছে, ভূতেরা আসলে কোনও কঠিন বা তরল খাদ্য খেতে পারে না। তারা খায় বায়বীয় খাবার। যেমন বাতাস, গন্ধ, আলো, অন্ধকার ইত্যাদি।