হারানচন্দ্র চিমটির জায়গাটায় হাত বোলাতে বোলাতে খেঁকিয়ে উঠলেন, “তোমার কবে আক্কেল হবে বলো তো! সকালবেলাতেই এমন সব কথা বলো যে পিত্তি জ্বলে যায়। একে কাল রাতে ঘুম হয়নি, মাথাটা কেমন টলমল করছে।”
জটাই তান্ত্রিক করোটিটা গঙ্গাজলে ধুয়ে তুলে রাখলেন। তারপর আচমন করে রক্তাম্বরে মুখ মুছে বললেন, “ঘুম হয়নি কেন?”
“ইয়ে, রাত্রে মনে হয় চোর এসেছিল।”
“আবার চোর?”
হারানচন্দ্র প্রথমেই ভূতের কথাটা তুলতে লজ্জা পাচ্ছিলেন। তাই ভাবছিলেন একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথাটা তুলবেন। এবার বললেন, “চোর বলেই মনে হয়েছিল। আমি তাদের কথাবার্তা শুনেছি, গানবাজনাও। কিন্তু…”
জটাই তান্ত্রিক খুব অবাক হয়ে বলেন, “চোর তোমার বাড়িতে এসে গানবাজনা করেছে? বলো কী?”
হারানচন্দ্র লজ্জিত হয়ে বলেন, “সেখানেই গোলমাল। চোর গানবাজনা করতে গেরস্তবাড়িতে ঢোকে না। তারা হাসেও না। কিন্তু কাল রাতে এ-সবই ঘটেছে। আমি ছাড়া অবশ্য আর কেউ কিছু শোনেনি। তাই ভাবছিলাম এসব ইয়ে নয় তো! সেই যে কী যেন বলো তোমরা!”
জটাই তান্ত্রিক বাল্যবন্ধুর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, “কিসের কথা বলছ বলো তো?”
“ইয়ে, মানে ওইসব আর কি! ওই যে তুমি যাদের দিয়ে তোমার বুজরুকিগুলো করাও। তাই ভাবছিলাম ব্যাপারটা তোমাকে বলি।”
জটাই তান্ত্রিক মাথা নেড়ে বলেন, “বুজরুকি আমি কখনও করিনি। কী জিনিস তাও জানি না। কাল রাতে কি তোমার বাড়িতে কোনও ভৌতিক ঘটনা ঘটেছে?”
“ইয়ে, অনেকটা তাই। তবে আমি ওসব বিশ্বাস করি না তা আগেই বলে রাখছি।”
জটাই তান্ত্রিক গম্ভীর হয়ে বলেন, “খুলে বলল।”
হারানচন্দ্র বললেন। জটাই তান্ত্রিক ঊধ্বনেত্র হয়ে চুপ করে বসে শুনলেন।
বলা শেষ হলে জটাই তান্ত্রিক একটা বিশাল শ্বাস ফেলে বললেন, “বুঝেছি।”
“কী বুঝলে?”
“ব্যাপারটা খুব সহজ নয় হে হারান।”
হারান মুখ ভেংচে বললেন, “সহজ নয় হে হারান! খুব বললে! এতকাল জপতপের ভণ্ডামি করে এখন ‘সহজ নয় হে হারান’ বলবে, এটা শোনার জন্য তো তোমার কাছে আসিনি! বলি, কিছু বুঝেছ ব্যাপারটা?”
“বুঝেছি।”
“ছাই বুঝেছ! কী বলো তো?”
জটাই তান্ত্রিক গম্ভীর হয়ে বললেন, “ঘড়ি।”
“ঘড়ি? তার মানে?”
“তোমার ওই নতুন ঘড়িটা গো। ওটাই যত নষ্টের মূল।”
হারানচন্দ্র তাড়াতাড়ি হাতঘড়িটার দিকে তাকালেন। ঘড়িটা একটু অস্বাভাবিক বটে। এখনও পর্যন্ত তিনি ঘড়ি দেখে সময় আঁচ করতে পারেননি। কাঁটা দুটো কখন যে কোন ঘরে থাকবে, তার কোনও স্থিরতা নেই। এইসব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি তাঁর পছন্দ নয়। সাবেকি জিনিস অনেক ভাল।
তিনি বললেন, “ঘড়ির সঙ্গে এসব ঘটনার কী সম্পর্ক? কী যে সব পাগলের মতো কথা বলো।”
জটাই তান্ত্রিক গম্ভীর হয়ে বললেন, “এর আগে কোনওদিন এরকম ঘটনা ঘটেছে?”
“না।”
“ঘড়িটা আসার পরেই কেন ঘটল তা ভেবে দেখেছ?”
“ভাববার সময় পেলাম কোথায়?”
“আমার কিন্তু ভাবা হয়ে গেছে।”
“কী বুঝলে ভেবে?”
“বুঝলাম যে, ঘড়িটা নতুন নয়। নিশ্চয়ই এর আগে ঘড়িটার একজন মালিক ছিল। কোনও কারণে সেই মালিকের মৃত্যু ঘটেছে। এবং সে ঘড়ির মায়া এখনও কাটাতে পারেনি। আত্মাটা ঘড়ির কাছাকাছি ঘুরঘুর করছে। কাল রাতে তুমি যে-সব শব্দ শুনেছ, তা সম্পূর্ণ ভৌতিক।”
হারানচন্দ্র বেকুবের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে খেঁকিয়ে উঠতে গিয়েও পারলেন না। কথাটা তাঁর অযৌক্তিক মনে হচ্ছে না তো! ঘড়িটা ভাল করে আবার দেখলেন তিনি। সাধারণ কব্জিঘড়ির মতোই, একটু হয়তো বা বড়। ঝকমকে স্টেনলেস স্টিলের। পুরনো নয় বটে, তবে সেকেন্ডহ্যান্ড হতে বাধা নেই।
এসব জিনিস তো বহুকাল নতুনের মতোই থাকে!
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ইয়ে, ওসব আমি মানছি কিন্তু। মানে ভূতটুত আমি বিশ্বাস করছি না। তবে যদি ওসব ইয়ে থেকেই থাকে, তবে তোমাদের তন্ত্রেমন্ত্রে কোনও বিধান নেই?”
জটাই তান্ত্রিক হাত বাড়িয়ে বললেন, “ঘড়িটা দাও দেখি।” হারানচন্দ্র ঘড়িটা হাত থেকে খুলে দিলেন। জটাই তান্ত্রিক সেটা অনেকক্ষণ হাতের মুঠোয় ধরে ধ্যানস্থ থাকলেন। তারপর খুব দূরাগত স্বরে বলতে লাগলেন, “টবিন সাহেব…বেঁটেখাটো, ভারী জোয়ান…মুখটা দেখলেই মনে হয় খুনি…লন্ডনের সোহো এলাকার একটা গলি ধরে দৌড়োচ্ছে…মধ্যরাত্রি..পিছনে একটা কালো গাড়ি আসছে…টবিন চৌমাথায় পৌঁছে গেছে…পিছন থেকে
গুড়ম করে গুলির শব্দ…টবিন মাটিতে বসে পড়ল…গুলি লাগেনি..সামনেই একটা ট্যাক্সি…টবিন এক লাফে উঠে পড়ল…কালো গাড়ি থেকে আবার গুলি…ট্যাক্সিটা জোরে যাচ্ছে..জাহাজঘাটা…একটা জাহাজ ছেড়ে যাচ্ছে…ডেক থেকে টবিন ঝুঁকে চারদিকে লক্ষ রাখছে…হাতে ঘড়ি…এই ঘড়িটা…জাহাজ আটলান্টিক মহাসাগর পার হচ্ছে…রাত্রি…টবিনের কেবিনের দরজা আস্তে খুলে গেল…কে…গুড়ম…গুড়ম…”
হারানচন্দ্র হাঁ করে জটাই তান্ত্রিকের মুখের দিকে চেয়ে আছেন।
জটাই চোখ খুলে বললেন, “জলের মতো পরিষ্কার। এ হচ্ছে টবিনের ঘড়ি…”
“টবিন কে?”
“একটা খুনি, গুণ্ডা, ডাকাত।”
“তুমি জানলে কী করে?”
“ধ্যানযোগে।”
হারানচন্দ্র রেগে উঠতে গিয়েও পারলেন না। কে জানে বাবা, সত্যি হতেও পারে। বললেন, “টবিন কি খুন হয়েছে নাকি?”
“তবে আর বলছি কী? তার আত্মা ঘড়িটার সঙ্গে লেগে আছে।”