হারানচন্দ্র স্তিমিত হয়ে বলেন, “তা ও ওরকম বলে কেন?”
জটাই তান্ত্রিক করোটিটা ঝোলা থেকে বের করে টেবিলে রেখে বলেন, “আহা, বলুক, বলুক বৌঠান। মরা মরা বলতে বলতে যদি কোনওদিন রামনাম ফুটে ওঠে।”
হারানচন্দ্র রাত্রে ঘড়িটা বালিশের তলায় নিয়ে শুলেন। মাঝরাতে হঠাৎ তিনি চেঁচামেচি করে উঠলেন, “এই, শিগগির রেডিওটা বন্ধ কর। এত রাত্রে রেডিও শুনছে কে রে? অ্যাঁ!”
হারানচন্দ্রের বাজখাঁই গলার চিৎকারে বাড়িসুষ্ঠু লোক উঠে পড়ে। কে রেডিও চালাচ্ছে তার খোঁজ শুরু হয়ে যায়।
বাসবনলিনী উঠে সবাইকে ধমক দিয়ে বলেন, “তোদের কি মাথা খারাপ হল নাকি যে, ওঁর কথায় কান দিচ্ছিস! রেডিও কোথায় যে বাজবে? রেডিও চুরি হয়ে গেছে না?”
তখন সকলের খেয়াল হল। তাই তো! বাড়িতে রেডিওই নেই যে!
হারানচন্দ্র আমতা-আমতা করে বলেন, “কিন্তু আমি যে স্পষ্ট শুনেছি। রেডিওতে গান হচ্ছে। কথাবার্তা হচ্ছে।”
বাসবনলিনী রাগ করে বলেন, “এত রাত্রে রেডিওতে গানবাজনা হয় বলে শুনেছ? রেডিওর লোকেদের কি ঘুম নেই?”
তাও বটে। হারানচন্দ্র বালিশের তলা থেকে ঘড়িটা বের করে দেখলেন। তারপরই আঁতকে উঠে বললেন, “এ কী? এ যে দেখছি ভোর হয়ে গেছে। সকাল ছটা বাজে যে! না, না, আটটা, নাকি…দূর ছাই, এ ঘড়ির যে কিছুই বোঝা যায় না!”
বাসবনলিনী উদার গলায় বললেন, “আর কষ্ট করে ঘড়ি দেখতে হবে না। আমি একটু আগেই দেয়াল-ঘড়িতে রাত দুটোর ঘণ্টা শুনেছি। এখন দয়া করে ঘুমোও।”
লজ্জা পেয়ে হারানচন্দ্র ঘুমোলেন। কিন্তু একটু পরেই তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। খুব কাছেই যেন কারা চাপা গলায় কথাবার্তা বলছে। ভাষাটা একটু বিচিত্র।
হারানচন্দ্র চোর এসেছে বুঝতে পেরে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলেন, “চোর! চোর! পাকড়ো!”
আবার বাড়িসদ্ধ লোক উঠে ছোটাছুটি দৌড়োদৌড়ি শুরু করল। কিন্তু চোরের কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না। বন্ধ দরজা বা জানালার শিক সব অক্ষত আছে। খাটের তলা বা পাটাতনেও কেউ লুকিয়ে নেই।
হারানচন্দ্র মাথা চুলকে বললেন, “একজন নয়। কয়েকজন চোর এসেছিল। তাদের মধ্যে একজন আবার মেয়েছেলে। আমি স্পষ্ট তাদের কথা শুনেছি।”
বাসবনলিনী চোখ পাকিয়ে বললেন, “কী বলছিল তারা শুনি!”
“কথাটা ঠিক ধরতে পারলাম না। ভাষাটা অন্যরকম।”
“জন্মে শুনিনি যে, চোরে চুরি করতে এসে কথা বলে। তোমার আজ হয়েছে কী বলো তো! এই রেডিওর শব্দ শুনছ, এই চোরের কথাবার্তা শুনছ! বলি লোককে ঘুমোতে দেবে, না কী?”
হারানচন্দ্র ধমক খেয়ে আবার শুলেন। কিন্তু ঘুম এল না। চোখ বুজে নানা কথা ভাবছেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন, কাক ডাকছে, কোকিল ডাকছে, শাঁখ বাজছে। চমকে উঠে বসলেন। তবে এবার আর চেঁচামেচি করলেন না তাঁর মনে হল, বাস্তবিক তিনি স্বপ্নই দেখছেন বোধহয়। কারণ, কাক ডাকার কোনও কারণ নেই। ভোর হতে বিস্তর বাকি। বাইরে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার।
হারানচন্দ্র বসে বসে ভাবতে লাগলেন, এসব হচ্ছেটা কী?
তিনি যা শুনছেন তা মিথ্যে নয়। অথচ আর কেউ শুনছে না। কেন? ভাবতে ভাবতে বালিশের তলা থেকে ঘড়িটা বের করে হাতে পরলেন, তারপর বিছানা থেকে নেমে বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে আরও ভাবতে লাগলেন।
আচমকা একটা মেয়ে খুব কাছেই কোথাও খিলখিল করে হেসে উঠল। হারানচন্দ্র চমকে উঠে চারদিকে তাকালেন। কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। হাসির শব্দটা ঠিক স্বাভাবিক নয়, একটা ধাতব শব্দ। যেমন লাউডস্পিকার বা রেডিওতে শোনা যায়। হারানচন্দ্র উঠে চারদিকটা ঘুরে এলেন। না, কেউ কোথাও নেই। এসে আবার বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসেই তাঁর একটা খটকা লাগল। এই যে তিনি বাড়ির ভিতরে চারদিক ঘুরে এলেন, কিন্তু তিনি তো আলো জ্বালাননি। ঘরগুলো তো অন্ধকার। আলো না জ্বালিয়েও তিনি সবই দেখতে পেয়েছেন। এটা কী করে সম্ভব হল?
নাঃ, আজ মাথাটা বড় গরম হয়েছে। একবার তাঁর এও মনে হল, জটাই তান্ত্রিককে অত গালাগালি রোজ করেন বলেই বোধহয় তান্ত্রিকের পোষা ভূতেরা এসে এসব কাণ্ড করছে। কাল সকালেই একবার জটাইয়ের কাছে যেতে হবে। হারানচন্দ্র ভূত বা ভগবান মানেন না বটে, কিন্তু এখন কেমন যেন একটা সন্দেহ হচ্ছে। গা ছমছম করছে।
ভোরের দিকটায় হারানচন্দ্র ইজিচেয়ারে শুয়েই একটু ঘুমোলেন। ঘুম ভাঙল আবছা আলো ফুটে ওঠার পর।
২. সূর্যোদয়ের আগেই সাধুদের প্রাতঃকৃত্য
সূর্যোদয়ের আগেই সাধুদের প্রাতঃকৃত্য, জপতপ সব শেষ করতে হয়। জটাই তান্ত্রিক সব সেরে তাঁর সাধনপীঠের উঠোনে বসে হরি ডোমের করোটিতে করে চা খাচ্ছিলেন। হারানচন্দ্রকে আগড় ঠেলে ঢুকতে দেখে খুব একটা অবাক হলেন না। প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে হারানচন্দ্র প্রায়ই তাঁর কাছে এসে বসেন এবং তন্ত্রসাধনা ও ধর্ম ইত্যাদির অসারতা প্রমাণ করে উঠে যান।
আজ হারানচন্দ্রকে একটু কাহিল দেখাচ্ছিল। কণ্ঠস্বরটা তেমন তেজী নয়। একটা মোড়া টেনে বসে বারকয়েক গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, “ওহে, ইয়ে, কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি।”
জটাই তান্ত্রিক মুখ থেকে করোৰ্টিটা নামিয়ে বললেন, “ঘুম হয়নি মানে? তুমি কি এখনও জেগে আছ নাকি?”
“জেগে নেই?” বলে আতঙ্কিত হারানচন্দ্র নিজের গায়ে নিজেই একটা চিমটি কেটে “উঃ” করে ককিয়ে ওঠেন।
জটাই তান্ত্রিক উদার হাস্যে মুখোনা ভাসিয়ে বলেন, “না, না, তোমার দেহের ঘুম ভেঙেছে বটে হে হারান, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আত্মার ঘুম! তাকে জাগাবে কবে? সে যদি না জাগল, তবে আর জাগ্রত আছ বলি কী করে?”