লাটু হঠাৎ ডুকরে উঠে বলে, “কাজি মরে গেছে! কাজি মরে গেছে!”
রামরাহার মুখটা কেমন অদ্ভুত করুণ হয়ে যায়।
বাতাসের গোলা কোথায় দাগছে খ্রাচ খ্রাচ তা বোঝা যায় না ঠিক। তবে মাটি আরও জোরে কেঁপে ওঠে। গাছপালা ভেঙে পড়তে থাকে বাগানে। কয়েকটা কুকুর আর্তনাদ করে চিরকালের মতো চুপ করে যায়। গর্ডনের পিসি, “ও গড! ও গড!” বলে চিৎকার করে উঠোনে দৌড়াদৌড়ি করে।
রামরাহা টেবিলের প্রতিবস্তুর দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে। তারপর বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলে, “র্যাডাক্যালি, এভাবে আত্মহত্যা করার প্রয়োজন ছিল না তোমার।”
লাটু পড়ে গিয়েছিল ফের। উঠতে উঠতে বলল, “কাজি তোমাকে শত্রু ভাবত।”
রামরাহা মাথা নেড়ে বলল, “ভাবত না। তাকে ওরকম ভাবতে শিখিয়েছিল খ্রাচ খ্রাচ। র্যাডাক্যালির নৈতিক বোধ নষ্ট করেছে খ্রাচ খ্রাচ। আর কয়েকটা দিন তাকে হাতে পেলে শুধরে নিতাম।
বাইরে এক অপার্থিব বেগুনি আলোয় ভরে যাচ্ছিল চারদিক। মুহুর্মুহু বাতাসের গোলা এসে ছয়ছত্রখান করে দিয়েছে সবকিছু। ধড়াস করে ওয়ার্কশপের অনেকটা দেয়াল ধসে গেল একদিকে। উড়ুক্কু মোটর সাইকেলটা মুখ থুবড়ে পড়ে একেবারে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেল। টুকরো-টুকরো হয়ে গেল গর্ডনের কলের মানুষ। ঝড়ের বাক্স চৌচির। লাটু আর কাজি মিলে সম্পূর্ণ করেছিল গর্ডনের এসব খেলনা। লাটু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখল শুধু।
ঘনীভূত ও নিরেট বাতাসের আর-একটা অতিকায় গোলা পড়ল কোথায় যেন। খুব কাছে। একটা একশো মাইল বেগের ঝড় এসে বাগানের গাছপালা শিকড়সমেত উড়িয়ে নিয়ে গেল। সেইসঙ্গে উড়ে গেল ওয়ার্কশপের চাল।
লাটু আকাশের দিকে চেয়ে দেখে, তারাভরা আকাশ থেকে একটা মস্ত থালার মতো মহাকাশযান নেমে আসছে।
রামরাহা মৃদু স্বরে বলে, “চুপ করে থাকো, কোনও কথা বোলো।”
“তুমি?”
“আমি! আমাকে একটু লুকিয়ে থাকতে হবে। তুমি ভয় পেও না। আমি কাছেই থাকব।”
মহাকাশযান ত্রিশ ফুট ওপরে ভাসতে লাগল স্থির হয়ে। তার তলায় একটা ছোট্ট গোল ছিদ্র দেখা দিল। কে যেন সেই ফুটো দিয়ে লাফ দিল নীচে। সোজা সে এসে নামল লাটুর সামনে।
লাটু দেখল থ্রাচ খ্রাচ। তেমনি অদ্ভুত পোশাক তার পরনে, তেমনি অদ্ভুত টুপি, আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো লম্বা মুখ! দশাসই চেহারা। একবার টেবিলের প্রতিবস্তু এবং একবার লাটুর মুখের দিকে চেয়ে সে একটু হাসল। তারপর ভারী একটা হাতে লাটুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “শাবাশ! তুমি কথা রেখেছ।”
লাটু-জবাব দিতে পারল না। সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইল।
খ্রাচ খ্রাচ টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে লোভাতুর চোখে চেয়ে রইল প্রতিবস্তুর কাজির দিকে। অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে লাটুর দিকে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে হিংস্র গলায় বলল, “রামরাহা কোথায়? সে এখানেই ছিল। আমি তার স্পন্দন আমার সেনসরে টের পাচ্ছি। কোথায় সে?”
লাটু মাথা নেড়ে জানাল, সে জানে না, তার গলার স্বর ফুটছিল না।
খ্রাচ ব্রাচ গম্ভীর বজ্রনিনাদে বলল, “শোনো খুদে মুখ মানুষ, রামরাহা যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন কাজি নিরাপদ নয়। তাকে ধ্বংস করতেই হবে। যদি সত্যি কথা না বললো, তা হলে পৃথিবীকে ধ্বংস করা ছাড়া আমার উপায় থাকবে না।”
ভয়ে লাটুর হাত পা হিম হয়ে যাচ্ছিল, সে কোনও জবাব দিতে পারল না। খ্রাচ খ্রাচ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, “রামরাহা এখনও পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারেনি, আমি জানি। কিন্তু তাঁকে খুঁজে বের করার মতো সময় আমার নেই। আমি কাজিকে নিয়ে যাচ্ছি। মহাকাশযানে ফিরে গিয়েই আমি সুপারচার্জার দিয়ে পৃথিবীকে একেবারে ধুলো করে দেব। তুমি আমার মস্ত উপকার করেছ, তবু আমার কিছু করার নেই।”
এই বলে খ্রাচ খ্রাচ হাত বাড়িয়ে প্রতিবস্তুর কাজিকে স্পর্শ করল।
লাটু কোনও মানুষকে এরকমভাবে বাতাস হয়ে যেতে দেখেনি কখনও। আজ সে চোখের পলক একবারও না ফেলে দৃশ্যটা দেখল। খ্রাচ খ্রাচ কাজিকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার মস্ত শরীরটায় একটা তীব্র শিহরণ বয়ে গেল। হঠাৎ শূন্যে উৎক্ষিপ্ত হল সে। তারপর অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন কয়েকটা ঘূর্ণিঝড় তার শরীরে পাক দিতে লাগল। হাত গলে গেল, পা গলে গেল, মাথা, বুক, চোখ সব যেন গলে গলে মিশে যেতে লাগল বাতাসে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপর খ্রাচ খ্রাচ এবং প্রতিবস্তুতে তৈরি কাজির কোনও চিহ্নও রইল না কোথাও।
শূন্যে ভাসমান ব্রাচ খ্রাচের মহাকাশযান কী বুঝল কে জানে। হঠাৎ একটা বেগুনি রশ্মিতে চারদিক উদ্ভাসিত করে বিদ্যুৎ-বেগে সেটা মিলিয়ে গেল আকাশে।
লাটু ক্লান্তভাবে বসে পড়ল ইজিচেয়ারটায়।
একটা. কাবার্ডের আড়াল থেকে রামরাহা বেরিয়ে এল ধীর পায়ে। হাতে কাজির মৃতদেহ। মাথা নেড়ে বলল, “কাজি বেঁচে নেই। তবু আমাকে চেষ্টা করে যেতে হবে ওকে আবার বাঁচিয়ে ভোলার জন্য। যতদিন না পারছি, ততদিন তোমাদের গ্রহে আমাকে থেকে যেতে হবে।”
লাটু লাফিয়ে উঠল আনন্দে। থাকবে? থাকবে রামরাহা?” রামরাহা মাথা নেড়ে বলে, “থাকব, তবে সমুদ্রের তলায়, আমার মহাকাশযানে।”
“কিন্তু তোমাকে যে আমার দেখতে ইচ্ছে করবে!”
“ডাকলেই আমি দেখা দেব।”
“কীভাবে?”
রামরাহা একটা ঘড়ি বের করে লাটুর হাতে দিয়ে বলে, “এটা একটা সাধারণ ঘড়ি। তবে এর চাবিটা উল্টোদিকে ঘোরালেই আমি সংকেত পাব। তবে খুব প্রয়োজন ছাড়া আমাকে ডেকো না। কেমন?”