“না লাটু, আমাকে স্পর্শ করার আগে আমি আসল না প্রতিবস্তু তা বোঝার কোনও উপায় নেই। আর স্পর্শ করার পর বুঝলেও লাভ নেই।”
কাজিকে দু হাতের আঁজলায় ধরে চেয়ে থাকে লাটু। দুঃখে তার চোখে জল এসে যায়। সে কাজির দোসরের দিকে চেয়ে কান্নায় অস্ফুট স্বরে বলল, “এই কাজি কি আর কখনও বেঁচে উঠবে না?”
“আমি তা বলতে পারি না। শুধু জানি, তোমাকে বাঁচানোর জন্যই কাজি তার প্রাণ দিয়ে আমাকে তৈরি করে গেছে।”
“আমাকে বাঁচানোর জন্য?”
“হ্যাঁ, লাটু। দুই মহাশক্তিধর মানুষের লড়াই শুরু হত আগামীকাল। কাজির জন্য। সে লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে তোমাকে মরতে হত। কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনা রইল না। যে প্রথমে আসবে তাকেই তুমি দান করে দিও আমাকে। আমি তাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ধুলো বানিয়ে দেব। তোমার কোনও ক্ষতি হবে না।”
“আর তুমি?”
“ধ্বংস করা এবং ধ্বংস হওয়ার জন্যই আমার জন্ম। আমার জন্য ভেবো না। কাজিকে কবর দিয়ে এসো।”
লাটু এ-আদেশ পালন করতে পারল না। সারাদিন সে কাজির মৃতদেহ হাতে নিয়ে বসে রইল পুতুলের মতো। আস্তে আস্তে দিন গিয়ে বিকেল, তারপর সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি নামল চারধারে।
আগামী কাল সকালে আসবে রামরাহা আর খ্রাচ খ্রাচ। কিন্তু লাটুর ভয় ছিল না। এক গভীর শোকে তার বুক ভার হয়ে আছে। কাজিকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখে লাটু ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
খুব ভোররাত্রে আকাশে কয়েকটা অদ্ভুত চলমান উজ্জ্বল নক্ষত্রকে দেখা গেল। অতি দ্রুত তারা পশ্চিমের আকাশ থেকে ছুটে আসছিল পৃথিবীর দিকে। কয়েক সেকেন্ড পৃথিবীর সমস্ত মানমন্দিরের দূরবীক্ষণে দেখা গেল তাদের। একটা হৈচৈ পড়ে গেল। কিন্তু আচমকাই কী হল, সমস্ত আলোগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। চলমান নক্ষত্রগুলোকে আর কোথাও দেখা গেল না।
শেষ রাত্রে এক ট্রেন থামল স্টেশনে। ছ ফুট লম্বা এবং অতিকায় সুদর্শন একজন যুবক স্যুটকেস হাতে প্ল্যাটফর্মে নামল। চারদিকে একবার চেয়ে সে পকেট থেকে ক্যালকুলেটরের মতো একটা যন্ত্র বের করে কী যেন দেখল। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগল গর্ডনসাহেবের বাড়ির দিকে।
***
কোনও শব্দ হয়নি, তবু ভোর রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল লাটুর।
চোখ চেয়ে চমকে সোজা হয়ে বসল সে। তার সামনে টেবিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে রামরাহা। কী অসাধারণ সুপুরুষ! কী চওড়া কাঁধ! কী বিশাল দুই হাত! চোখ দুটি স্নিগ্ধ, মুখে মৃদু একটু হাসি।
লাটু তাকাতেই রামরাহা বলল, “আমার কথা বোধহয় তুমি জানো?”
“হ্যাঁ। আপনি রামরাহা।”
“আমি র্যাডাক্যালিকে নিয়ে যেতে এসেছি। তুমি কি অনুমতি দেবে?”
লাটুর মাথা ঘুলিয়ে যাচ্ছিল। রামরাহা টেবিলের ওপর রাখা প্রতিবস্তুর কাজির দিকে চেয়ে আছে। মুখোনা স্নেহসিক্ত, সেইভাবে চেয়ে থেকেই রামরাহা বলল, “বড় দুষ্টু যন্ত্র। কিছুতেই স্থির থাকতে চায় না। আমি ওকে নিয়ে যখন পালিয়ে আসছিলাম তখন তোমাদের গ্রহে আশ্রয় নিতে হয়। সেই সময় ও আমার মহাকাশযান থেকে ছিটকে পড়ে পালিয়ে যায়। অনেকদিন পর আজ ওর খোঁজ পেয়েছি।”
লাটু মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে। রামরাহার চেহারা সুন্দর, ব্যবহার ভাল, কিন্তু তাতে কী? ও যে কাজির শত্রু!
রামরাহা টেবিলের দিকে একটা হাত প্রসারিত করে বলে, “এর বদলে তোমাকে আমি একটা সুন্দর জিনিস দেব।”
প্রতিবস্তুর তৈরি কাজি টেবিলের ওপরে থেকেও কিন্তু টেবিলকে স্পর্শ করেনি। দুই সেন্টিমিটার ওপরে ভেসে ছিল। কেন তা লাটু জানে। পৃথিবীর বিজ্ঞান যত অনুন্নতই হোক তবু লাটু এ খবর রাখে যে, প্রতিবস্তুকে স্পর্শ করলেই অন্য যে কোনও জিনিসের অস্তিত্ব লোপ পায়। রামরাহা কি লক্ষ করছে যে, প্রতিবস্তুর তৈরি কাজি ভাসছে? না, করেনি। রামরাহার হাত এগিয়ে যাচ্ছে মারাত্মক জিনিসটার দিকে।
এখন কী করবে লাটু? রামরাহাকে তার ভীষণ ভাল লাগছে যে! সে বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলল, “ওটা ছুঁয়ো না, ওটা আমার জিনিস!”।
ঠিক এই সময়ে তাদের চমকে দিয়ে হঠাৎ মাটি কেঁপে উঠল থরথর করে। রাডাক্যালির একটা অদৃশ্য বস্তু যেন ধাক্কা দিল পৃথিবীর গায়ে। ভূমিকম্প নয়, ভূমিকম্প অন্যরকম।
রামরাহার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে একবার ওপরের দিকে চাইল। তারপর বলল, “খ্রাচ খ্রাচ বাতাসের বুদ্বুদ ছুঁড়ে মারছে। শোনো ছোট্ট মানুষ, আর সময় নেই। খ্রাচ খ্রাচ যদি আমার নাগাল পায়, তবে লড়াই হবেই। আমাদের মধ্যে কে হারবে জানি না, কিন্তু সে লড়াইয়ে পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে। অনুমতি দাও, আমি র্যাডাক্যালিকে নিয়ে মহাশূন্যে চলে যাই। লড়াই হলে সেখানেই হোক।”
রামরাহা কাজির দিকে ফের হাত বাড়াতেই আবার পৃথিবী দুলে উঠল প্রবল ধাক্কায়। খ্রাচ ব্রাচের বিশালকায় বাতাসি বুদ্বুদ ঘণ্টায় কয়েক হাজার মাইল বেগে এসে পড়েছিল আশেপাশে। বাইরে কুকুরগুলো মর্মন্তুদ আর্তনাদ করে ওঠে। ওয়ার্কশপের একটা ধার ভেঙে পড়ে মাটিতে। বাগানের গাছপালায় তীব্র আন্দোলন, পাখিরা প্রাণভয়ে সমস্বরে চেঁচাতে থাকে।
ইজিচেয়ার সুদ্ধ পড়ে গিয়েছিল লাটু। চারদিক ভয়ংকর জ্বলছে, তার মাথা ঘুরছে। আতঙ্কে শুকিয়ে যাচ্ছে বুক। রামরাহা তাকে তুলে দাঁড় করায়। কী জোরালো হাত, অথচ কী নরম!
রামরাহা মাটি থেকে কী একটা কুড়িয়ে নিয়ে লাটুর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে বলল, “এটা কী? এই তো দেখছি র্যাড়াক্যালি!”