“রাডাক্যালি, আমি তোমার আবিষ্কর্তা, আমি তোমার স্রষ্টা। কেন ধরা দিচ্ছ না র্যাড়াক্যালি? কেন আবরণী রশ্মি দিয়ে ঢেকে রেখেছ নিজেকে? তোমার ক্ষমতা অসীম। তুমি আকাশের সমস্ত গ্রহনক্ষত্রকে কক্ষচ্যুত করে দিতে পারো, সমস্ত কসমিক প্যাটার্নকে পাল্টে দিতে পারো তুমি। এ গ্রহের নাবালকেরা তোমাকে ভুলভাবে ব্যবহার করলে কত সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে রাডাক্যালি! খ্রাচ খ্রাচ তোমাকে পেলে ব্যবহার করবে দাসত্বের কাজে। তোমার সত্যিকারের সদ্ব্যবহার জানে একটিমাত্র তোক। সে তোমার আবিষ্কতা এই আমি। ধরা দাও র্যাড়াক্যালি। আর সময় নেই।”
সেই গলার স্বর শুনে লাটুর সারা শরীরের রোমকূপ শিউরে ওঠে। বুকের ভিতরটা কেমন করতে থাকে। সে হঠাৎ সব ভুলে বলে ওঠে, “কাজি! রাডাক্যালি কে?”
পর্দায় রামরাহ হঠাৎ চমকে ওঠে। তারপর খুব দ্রুত হাতে একটা নব ঘোরাতে থাকে।
কাজি হতাশ গলায় বলে, “ছিঃ, লাটু! একটু সংযম নেই তোমার! আমি ধরা পড়ে গেলাম। ওই দ্যাখো, রামরাহা তার যন্ত্র গুটিয়ে নিচ্ছে। আর উপায় নেই।”
লাটু লজ্জায় ভয়ে কাঠ হয়ে গেল।
কাজি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “রাডাক্যালি আমারই নাম। রামরাহা আমাকে উদ্দেশ করেই কথাগুলো বলছিল।”
খুব সংকোচের সঙ্গে লাটু জিজ্ঞাসা করে “রামরাহাই কি তোমাকে আবিষ্কার করেছিল?”
“হ্যাঁ, লাটু।”
“তবে কেন তুমি ওর কাছে ধরা দিতে চাও না? রামরাহা তো দারুণ লোক।”
“ধরা দেওয়া সম্ভব নয় লাটু। খ্রাচ খ্রাচ আমাকে প্রি-প্ল্যানড করে রেখেছে। শত হলেও আমি যন্ত্র, আমাকে যান্ত্রিক নিয়মেই চলতে হয়। আমি কারও প্রতি পক্ষপাত পোষণ করতে পারি না। প্রয়োজন হলে তোমার সাহায্যে আমি রামরাহাকে মেরে ফেলব। হয়তো সেটাই একমাত্র পন্থা।”
“মেরে ফেলবে?”
লাটু খুব দুঃখের সঙ্গে বলল। তারপর অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলে, “আমার সাহায্যে কেন কাজি?”
“ওই যে বললাম, শত হলেও আমি যন্ত্র। কেউ না চালালে আমার পক্ষে চলা শক্ত। এখন একটা কাজ করো। ব্যান্ডের কাছে একটা আলপিনের মাথার মতো ছোট্ট বোম আছে। নখের ডগা দিয়ে সেটা খুব জোরে চেপে ধরো।”
লাটু বোতামটা খুঁজে পেয়ে নখ দিয়ে চেপে ধরল। ভিতরে ক্লিক করে একটা শব্দ হল মাত্র।
কাজি বলল, “এবার শোনো। রামরাহা আমার সন্ধান পেয়ে গেছে। কিন্তু সে তাড়াহুড়ো করবে না। তার কাছে এমন যন্ত্র আছে যার সাহায্যে সে চোখের পলকে এখানে পৌঁছে যেতে পারে। কিন্তু সেটা হঠকারীর মতো কাজ হবে। সে জানে আমি আত্মরক্ষার কৌশল জানি। তা ছাড়া সে ওইসব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে তোমাদের এই গ্রহের সাংঘাতিক ক্ষতি হতে পারে। রামরাহা সুতরাং সেগুলো ব্যবহার করবে না। সে বাস, ট্রেন ইত্যাদি যানবাহন ব্যবহার করবে। এখানে আসতে আমার হিসেবে রামরাহার সময় লাগবে আরও দু’দিন। ততক্ষণে খ্রাচ খ্রাচ পৌঁছে যাবে। আমাকে রেখে দাও সামনের টেবিলে। এই দুটো দিন তুমি চুপচাপ বসে থাকো। আমাকে ভুলেও স্পর্শ কোরো না। আমার কাছেও এসো না।”
“কেন কাজি?”
“তুমি কাল সকালে দেখতে পাবে সামনের টেবিলে হুবহু আমার মতো দেখতে দুটো কাজি রয়েছে। তোমার বাঁ দিকে থাকব সত্যিকারের আমি, ডান দিকে থাকবে প্রতিবস্তুতে তৈরি আমার দোসর। রামরাহা যদি এসেই পড়ে তাহলে তুমি বাঁ দিক থেকে আসল আমাকে সাবধানে সরিয়ে নিয়ে বাইরের জঙ্গলে ফেলে দিও। খবর্দার, ডানদিকেরটায় হাত দিও না। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়বে। রামরাহা প্রতিবস্তুতে তৈরি আমাকে স্পর্শ করা মাত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশ্য সেইসঙ্গে আমিও। এটাই অন্তিম উপায়।”
লাটু খুব ভয়ে ভয়ে কাজিকে টেবিলের ওপর রেখে দিল। কাজির ভিতরে বিচিত্র শব্দ উঠছিল। যেন কেউ খুব যন্ত্রণা পাচ্ছে, মর্মন্তুদ ব্যথা বেদনায় নানারকম শব্দ করছে।
এই কয়দিনে লাটু কাজিকে বড় ভালবেসে ফেলেছে। করুণ মুখে সে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে কাজি?”
“ভীষণ। মৃত্যুর আগে মানুষের এরকম যন্ত্রণা হয়।”
“কেন যন্ত্রণা হচ্ছে কাজি?”
“প্রতিবস্তুতে নিজের প্রতিকৃতি তৈরি করার মানে হল নিজের মৃত্যুর পথ পরিষ্কার করা। তুমি ঠিক বুঝবে না। আমার ভিতরে অণু ও পরমাণুর দুরকম চলন তৈরি হচ্ছে। একটা চলন আর-একটা চলনের ঠিক উল্টো। বড় কষ্ট।”
“রামরাহা কীরকম মানুষ কাজি?”
“সে আমার শত্রু।”
“খ্রাচ খ্রাচ কীরকম মানুষ কাজি?”
“সে আমার প্রভু।”
লাটু চুপচাপ বসে ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখল, টেবিলের ওপর পাশাপাশি দুটো কাজি পড়ে আছে।
হাত বাড়িয়ে বাঁ দিকের কাজিকে হাতে তুলে নেয় লাটু। “কাজি! কেমন আছ?” জবাব নেই। “কাজি! কথা বলছ না কেন?”
আচমকা টেবিলের ওপর থেকে প্রতিবস্তুতে তৈরি কাজি বলে উঠল, “ও কাজি মরে গেছে লাটু। ওকে বিরক্ত কোরো না।”
লাটু সভয়ে ডানদিকের কাজির দিকে চেয়ে রইল। তারপর ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল, “তুমি কি প্রতিবস্তুতে তৈরি কাজি?”
“হ্যাঁ, লাটু। আমাকে ভুলেও ছুঁয়ো না।”
“তুমি আর আগের মতো আমার বন্ধু নও?”
“না, লাটু। তবে আমি তোমার ক্ষতিও করব না। কাজি আমাকে প্রি-সেট করে রেখেছে। আমাকে না চুলে তোমার ভয় নেই।”
লাটু একটু ভেবে নিয়ে বলে, “রামরাহা কি ধরতে পারবে না যে, তুমি আসল কাজি নও! তার বুদ্ধি তো সাংঘাতিক।”