কিন্তু রামচন্দ্রের হাঁটা দেখে মনে হয়, তার বিশেষ কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। বেশ লঘু দ্রুত পায়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে।
পাকদণ্ডির শেষ। সামনে একটা মস্ত উপত্যকা। পুরোটা পুরু বরফে ঢেকে আছে। শোঁ শোঁ করে তুষারঝড় বয়ে যাচ্ছে তার ওপর দিয়ে। আকাশ কালো, কিছুই ভাল দেখা যায় না। তাপাঙ্ক শূন্যের পনেরো-কুড়ি ডিগ্রি নীচে নেমে গেছে।
রামচন্দ্রের পরনে শুধু পাতলা কাপড়ের একটা স্যুট। শীত সে টেরই পাচ্ছে না। উপত্যকার দিকে চেয়ে সে এক অদ্ভুত সুরে শিস দিয়েই যাচ্ছে। একবার সে ক্যালকুলেটরের মতো যন্ত্রটার দিকে তাকাল। দুটো একটু কোঁচকাল।
উপত্যকায় নামবার কোনও পথ নেই। রামচন্দ্র রাহা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তার সামনেই গভীর খাদ। প্রায় তিন হাজার ফুট নীচে তুষারক্ষেত্র। রামচন্দ্র রাহা শিস দিতে দিতেই সেই খাদের ধারে এসে দাঁড়াল। চারদিকে একটু চেয়ে দেখল সে। তারপর লাফিয়ে পড়ল নীচে।
তিন হাজার ফুট তো সোজা নয়। রামচন্দ্র রাহার ওপর থেকে নীচে পড়তে অনেকটা সময় লাগল। পড়তে-পড়তেই সে সেই অদ্ভুত সুরে শিস দিয়ে যাচ্ছিল।
নীচে নরম তুষার। তবু তিন হাজার ফুট ওপর থেকে পড়লে যে-কোনও মানুষেরই মাঝপথেই দম আটকে মরার কথা এবং শরীরটা একদম ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। রামচন্দ্র রাহার অবশ্য কিছুই হল না। তুষারের ওপর বেড়ালের মতো হালকাভাবে নামল সে, এবং ছোট্ট যন্ত্রটায় কী একটা দেখে নিয়ে এগোতে লাগল উত্তরের দিকে। যেদিকে আরও ঘোর গহিন তুষারের রাজ্য। মস্ত উঁচু দুর্গম সব মহাপর্বত। কীটপতঙ্গ, জনমানুষ, পশুপাখি কিছু নেই। শুধু সাদা তুষারের মরুভূমি। অবিরল হুহু করে ঝোড়ো বাতাস বইছে। রাশি রাশি পাতার মতো আকাশ থেকে নেমে আসছে তুষার। এত শীত যে, রক্ত জমাট বেঁধে যায়, হাত পা অসাড় হয়ে আসে। বাতাসে অক্সিজেন এত কম যে, দম নিতে কষ্ট হয়।
শিস দিতে দিতে প্যান্টের দু পকেটে দুটো হাত ভরে রামচন্দ্র রাহা একটা গিরিশিরা বেয়ে পিছল বরফের ওপর দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। এ পথ এত সরু যে, কোনওরকমে একটা পায়ের পাতা রাখা যায়। এত খাড়া যে, বরফ কাটার কুড়ল, পিটন এবং দড়ির অবলম্বন ছাড়া এ-পথ দিয়ে কোনও মানুষের পক্ষেই ওঠা সম্ভব নয়। ঝড়ের গতি এত বেশি যে, উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে।
সামনেই দুটো বিশাল চেহারার তুষারশুভ্র মূর্তি। ভালুক নয়, আবার মানুষও নয়। স্থির হয়ে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টিতে আদিম হিংস্রতা। বড় বড় সাদা লোমে ঢাক শরীর। কিংবদন্তীর ইয়েতি।
রামচন্দ্র রাহা এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। তারপর হাসল। ছোট্ট যন্ত্রটা বের করে সে নিজের ভাষায় বলল, “সুপ্রভাত। আমি তোমাদের দেশে একজন অচেনা বিদেশী অতিথি।”
যন্ত্রটার ভিতর দিয়ে রামচন্দ্র রাহার এই কথাগুলো কয়েকটা অচেনা শব্দ হয়ে বেরোল। কিন্তু ইয়েতি দুজন পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। অর্থাৎ তারা কথাগুলো বুঝতে পেরেছে।
রামচন্দ্র ফের জিজ্ঞেস করল, “আমি সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টা খুঁজছি। তোমরা দেখিয়ে দিতে পারো?”
ইয়েতিরা মাথা নাড়ল। দুজনেই হাত তুলে ওপরটা দেখাল। একটু অদ্ভুত শব্দ করল, “উমম! উমম্!”
যন্ত্রের ভিতর দিয়ে রামচন্দ্র রাহা শুনল, “ঐ যে! ঐ যে!” ইয়েতিরা পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। রামচন্দ্র রাহা পৃথিবীর সব থেকে উঁচু গিরিশৃঙ্গ এভারেস্টে উঠতে থাকে। শিস দিতে দিতে, পকেটে হাত ভরে।
***
দৃশ্যটা গর্ডন সাহেবের ওয়ার্কশপে বসে কাজির পর্দায় দেখতে পাচ্ছিল লাটু। সুপারম্যান, টারজান, ম্যানড্রেক : কাছে ছেলেমানুষ। যত সে দেখে, তত সম্মোহিত হয়ে যেতে থাকে।
কাজি প্রশ্ন করে, “রামরাহাকে কী রকম মনে হচ্ছে তোমার?”
“দারুণ।”
“ওর সঙ্গেই তোমার লড়াই কিন্তু। খ্রাচ খ্রাচের কথা ভুলে যেও না।”
এ-কথা শুনে কেন কে জানে লাটুর মনটা একটু খারাপ হয়ে। গেল।
কাজির পর্দায় তখন এভারেস্টে আরোহণকারী দুজন অভিযাত্রীকে দেখা যাচ্ছিল। পর্বতারোহীর পোশাক, অক্সিজেন সিলিন্ডার, কুড়ল, পিটনে সজ্জিত দুজন মানুষ অত্যন্ত ধীর গতিতে ওপরে উঠছিল। আচমকাই প্রথমজনের বরফে গাঁথা পিটনটা খসে যাওয়ায় সে পিছলে পড়ে যেতে লাগল নীচে। নীচে মানে অনেক নীচে। কয়েক হাজার ফুট।
লাটু ভয়ে চোখ বুজে ফেলে চেঁচিয়ে উঠল, “গেল গেল!” কিন্তু না। চোখ খুলে লাটু দেখল ঠিক সময়ে কখন রামরাহ। পথচ্যুত অভিযাত্রীর তলায় এসে দাঁড়িয়েছে। দুটো বিশাল হাতে সে বলের মতো লুফে নিল লোকটাকে। তারপর অনায়াসে তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে ফের গিরিশিরায় উঠে এসে যথাস্থানে নামিয়ে দিল। ফের পকেটে হাত ভরে এক উদাস সুরে শিস দিতে দিতে সে উঠে এল এভারেস্টের চূড়ায়।
লাটু মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখল, রামরাহা এভারেস্টের চূড়ায় উঠে আকাশের দিকে হাত বাড়াতেই তার সুটকেসটা কোন শূন্য থেকে ভাসতে ভাসতে নেমে এল। তিনটে ঠ্যাং বেরিয়ে এল সুটকেস থেকে। সেই তিন পায়ের ওপর সেটা স্থির হয়ে দাঁড়াল। রামরাহা একটা সুইচ টিপল স্যুটকেসের গায়ে।
কাজি ফিসফিস করে বলল, “লাটু, একটুও শব্দ কোরো না। রামরাহা তার বিমার চালু করেছে। একটু শব্দ হলেও সে টের পেয়ে যাবে।”
লাটু ভয়ে দম বন্ধ করে রইল।
আচমকাই সে কাজির ভিতর থেকে রামরাহার অদ্ভুত গম্ভীর গভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।