“কোনও চিন্তা নেই।” বলেই যুবকটি করিডোরে বেরিয়ে গেল। তারপর দরজা খুলে প্রায় চল্লিশ মাইল বেগের ট্রেন থেকে অনায়াসে নেমে গেল। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা আর একজন অবাঙালি যাত্রী ভয়ে কাঠ হয়ে জানালা দিয়ে চেয়েছিলেন। ছেলেটা হাড়গোড় ভেঙে দ হয়ে গেল নাকি!
কিন্তু ঠিক দশ মিনিটের মাথায় দেখা গেল, ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটি লোক লাইনের ধার ধরে দৌড়ে আসছে। ট্রেনের গতি আরও বেড়েছে। বোধহয় ঘণ্টায় ষাট মাইল। কিন্তু লোকটা অনায়াসে কামরাগুলোকে পিছনে ফেলে ফার্স্ট ক্লাসের দরজার হ্যান্ডেল ধরে লাফিয়ে উঠে পড়ল। কামরায় ঢুকে একমুখ হেসে হারটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “লোকটা বেশি দূর যেতে পারেনি। নদীর ওপর একটা ব্রিজ আছে, সেখানে একটা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে বসে যাচ্ছিল। নিন।”
ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা এবং কামরার আর একজন অবাঙালি যাত্রী এত অবাক হয়ে গেলেন যে, কথা বলতে পারলেন না।
যুবকটি অবশ্য কিছুই তেমন গ্রাহ্য করল না। একটু হাঁফাচ্ছিলও না সে। ফের নিজের জায়গায় বসে সেই অদ্ভুত সুরে শিস দিতে লাগল।
রাত একটু গম্ভীর হল। সহযাত্রীরা বিছানা-টিছানা পাতছে। এমন সময় আচমকা কামরার দরজাটা দড়াম করে খুলে চার-পাঁচজন ভয়ংকর চেহারার লোক ঢুকল। হাতে রিভলভার, ছোরা, স্টেনগান।
ঢুকেই তারা হিন্দিতে ধমক দিয়ে বলল, “কেউ নড়বে না, চেঁচাবে না। একদম জানে মেরে দেব।”
সকলেই হতভম্ব, ভয়ে হাত পা কাঁপছে। শুধু যুবকটি একটু অবাক হয়ে মাঝবয়সী ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে, “এরা কারা? এরকম করছে কেন?”
“বুঝছেন না মশাই!” ভদ্রলোক কাঁপতে কাঁপতে বলেন, “ডাকাত!”
“ডাকাত! সে আবার কী?”
“মেরেধরে কেড়েকুড়ে নেবে সব। যা আছে দিয়ে দিন যদি প্রাণে বাঁচতে চান।”
যুবকটি খুব অবাক ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ডাকাতদের দিকে। ডাকাতরা তখন উদ্দাম উল্লাসে ভদ্রমহিলার হাত থেকে চুড়ি খুলবার চেষ্টা করছে, বাক্স ভাঙছে।
যুবকটি উঠে একজন ডাকাতকে একটা চড় মারতেই সে ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ আর একজন ডাকাত যুবকটির বুকে নল ঠেকিয়ে পিস্তলের ঘোড়া টানল। আর একজন হাতের ছোরা খচ করে বসিয়ে দিল যুবকের পেটে।
যে কারও এতে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে মরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সকলে অবাক হয়ে দেখে, পিস্তলের গুলিটা ছিটকে গেল তার বুকে ধাক্কা খেয়ে। ছোরার ডগাটা ভেঙে পড়ে গেল মেঝেয়। পরের কয়েক সেকেন্ড সময় কাটল শুধু একতরফা মারে। পাঁচজন ডাকাত পাঁচ সেকেণ্ডে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেয়। যুবকটি তাদের দেহ একসঙ্গে দু বগলে তুলে নিয়ে করিডরের এককোণে রেখে এসে ফের সেই অদ্ভুত শিস দিতে লাগল।
মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর থাকতে পারলেন না। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কে বলুন তো!”
যুবকটি হেসে বলে, “আমার নাম রামচন্দ্র রাহা।”
“থাকেন কোথায়?”
“একটু দূরে।”
“যাচ্ছেন কোথায়?”
রাম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি একটা জিনিস খুঁজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু সেটা যে ঠিক কোথায় আছে, সেটাই ধরা যাচ্ছে না।”
এইসব রহস্যময় কথাবার্তা শুনে ভদ্রলোক আর দ্বিরুক্তি করলেন না।
সকলে বিছানা-টিছানা পেতে শুয়ে পড়তেই রামচন্দ্র তার শিসের সুর পাল্টে ফেলল। এবার যে সুরটা সে বাজাচ্ছিল, সেটা বড় মাদকতাময়। শুনতে শুনতে ঝিম ধরে যায়, ঘুম পেয়ে যায়।
অল্প সময়ের মধ্যেই তিনজন সহযাত্রী গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল। রামচন্দ্র তার পকেট থেকে একটা চৌকোনো যন্ত্র বের করে নানারকম সুইচ আর নব টিপে এবং ঘুরিয়ে কী যেন দেখল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “র্যাডাক্যালি! র্যাডাক্যালি!”
আবার কিছুক্ষণ যন্ত্রটা নাড়াচাড়া করল সে। তারপর বিষণ্ণভাবে মাথা নেড়ে আপনমনে বলল, “হিমালয়! হিমালয়!”
একটা জংশন স্টেশনে গাড়ি দাঁড়াতেই রামচন্দ্র তার স্যুটকেসটা নিয়ে নেমে পড়ল।
***
কাজি আচমকা বলে উঠল, “শোনো লাটু! রামরাহা আসছে।”
“আসছে!” লাটু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে তড়াক করে উঠে বসে।
কাজি বলে, “আসছে বটে। তবে আমি তাকে একটু দিকভ্রান্ত করে দিতে পেরেছি। সে আমার অবস্থান বুঝতে পারছে না। কলকাতার দিকে আসতে আসতে সে তাই মাঝপথে এক জায়গায় নেমে পড়েছে।”
“এরপর রামরাহা কী করবে?”
“খুব সম্ভব সে হিমালয়ের দিকে যাবে। আমি তাকে ওই দিকেই যেতে বাধ্য করেছি। তবে ভুলটা ধরা পড়তে তার বেশিক্ষণ লাগবে না।”
লাটু শিউরে উঠে চোখ বোজে। তারপর খুব ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করে, “কাজি, রামরাহা লোকটা কি খুবই ভয়ংকর?”
কাজি একটু চুপ করে থেকে বলে, “হ্যাঁ, শত্রু হিসেবে ভয়ংকর।”
“সে কি তোমার জন্য আমাদের খুন আর পৃথিবী ধ্বংস করবে?”
কাজি আবার একটু চুপ করে থেকে ধীর স্বরে বলল, “ইচ্ছে করলে সে পারে।”
লাটু হাল ছেড়ে ফের ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়ল।
কাজি বলল, “রামরাহা এখন কোথায় জানো?”
“না। বলো তো কোথায়?”
“একটা শহর ছেড়ে সে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটছে। সামনেই খাড়া পাহাড় এবং গিরিপথ। তারপরই তুষাররাজ্য। রামরাহা ভ্রূকুটি করছে, ঠোঁট কামড়াচ্ছে, সন্দেহ দেখা দিয়েছে তার মনে। সে ট্রেসার যন্ত্র বের করে আবার কিছু দেখে নিচ্ছে… না, সে এগিয়ে যাচ্ছে।..আপাতত কিছুক্ষণ নিশ্চিন্ত।”
***
রামচন্দ্র রাহা নামক সেই যুবকটি অত্যন্ত সংকীর্ণ একটা গিরিপথ দিয়ে এগোচ্ছিল। বাঁয়ে খাড়া পাহাড়ের দেয়াল, ডাইনে অতলগভীর খাদ। রাস্তা ভাঙা, এবড়োখেবড়ো, ভাল করে পা রাখার জায়গা নেই, তার ওপর বড্ড খাড়াই।