কাজি নিচু স্বরে বলল, “আমার ভূত-চুম্বকটা চালু করে দিয়েছি। এবার দ্যাখো কী মজা হয়।”
“আমার মজা লাগছে না। ভয় লাগছে।”
“আরে দূর! ভূতকে ভয় কী? দেখো চেয়ে। ওই একটা ঢুকেছে।”
প্রথমটায় লাটু দেখতে পায় না। তারপর ঘরের চালের কাছ থেকে একটা স্প্রিঙের মত জিনিসকে ঝুল খেতে দেখে।
“বাবা গো! ওটা কী কাজি?”
“প্যাঁচ-খাওয়া চেহারা দেখে বুঝতে পারছ না?”
“না।”
“ভূত হল মানুষের মানসিক-আত্মিক একটা অস্তিত্ব। মানুষের মন আর চরিত্র জ্যান্ত অবস্থায় যেমন ছিল মরার পর তার ভূতের চেহারাটা ঠিক সেরকম হয়ে যায়। ওই ভূতটা জ্যান্ত অবস্থায় ছিল ভারী প্যাঁচালো স্বভাবের, খুব কুটিল আর ধূর্ত।”
“বুঝেছি। আর ওই যে একটা লালমতো জোঁক তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছে?”
“ওটা ছিল এক ঝগড়াটি মহিলা।”
নানান চেহারার অজস্র ভূত ঘরে বিচরণ করছে। কেউ কেউ টুপটাপ করে চাল থেকে খসে পড়ছে, কেউ বাতামে সাঁতার কাটছে, কেউ মেঝেয় পড়ে বলের মতো লাফিয়ে উঠছে। নানান চেহারা, হরেক রং তাদের। একখানা ভূতকে দেখল লাটু, অবিকল একখানা বই। কাজি বলল, “এ লোকটা নাকি ছিল বইয়ের পোকা আর ভারী পণ্ডিত। বই পড়তে পড়তে বই হয়ে গেছে।”
লাটু কাজির ফুটো থেকে তারটা খুলে নিয়ে বলল, “আর নয়। একদিনে যথেষ্ট ভূত দেখা হয়েছে।”
ঘরের থমথমে ভুতুড়ে ভাবটা মিলিয়ে গেল। ভুতগুলোও আর রইল না।
কাজি বলল, “ভূতের ভয় ভেঙেছে তো!”
লাটু একগাল হেসে বলল, “ভেঙেছে কি না বলতে পারব না। তবে তেমন ভয় করছে না।”
কাজি এবার হুকুমের স্বরে বলল, “এবার ওঠো। অনেক রাত হয়েছে। ঘরের কোণে গর্ডনের মস্ত ফ্রিজ রয়েছে। তাতে ঠাসা খাবার। বের করে গ্যাস-উনুনে গরম করে খেয়ে নাও।”
লাটু, তাই করল।
কাজি হুকুম করল, “এবার ইজিচেয়ারে শুয়ে চোখ বোজো। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। আর শোনো, আমার ট্রেসারে এখনও রামরাহার কোনও নড়াচড়া টের পাচ্ছি না। পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে এলে আমি তার গায়ের গন্ধ পাব। পেলেই তোমাকে জাগিয়ে দেব। নিশ্চিন্তে ঘুমোও।”
লাটুর ঘুম ভাঙল সকালবেলায়। শরীর বেশ তাজা আর ঝরঝরে লাগছে। আসন্ন বিপদের কথা মনে থাকলেও বেশ স্ফূর্তি লাগছে তার।
দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে, বাথরুম সেরে এবং ফ্রিজের খাবার ভরপেট খেয়ে সে উড়কু মোটর সাইকেলে চড়ে বাগানের ওপর কয়েকটা চক্কর দিল। কলের মানুষটাকে দিয়ে ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করাল। সামান্য একটু ঝড় তুলে মজা দেখল।
কাজি আজ বেশি সাড়াশব্দ করছে না। ঝিম মেরে আছে। লাটু বলল, “কী গো কাজি? চুপচাপ যে!”
“রোসো। পশ্চিম দিকটায় ভারত মহাসাগর আছে না তোমাদের! সেখানে একটা কিছু ঘটছে।”
লাটু সভয়ে বলে, “কী ঘটছে?”
“এখনও বুঝতে পারছি না। আমার ট্রেসারে অন্য একটা ট্রেসারের ছায়া পড়ে কাটাকুটি হয়ে যাচ্ছে। খুব উন্নত ধরনের ট্রেসার সেটা। তোমাদের পৃথিবীর তৈরি জিনিস নয়। মনে হচ্ছে সমুদ্রের তলায় রামরাহা নড়াচড়া শুরু করেছে। “
“তাহলে?”
“তাহলে আর কী? লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হও।”
“কিন্তু কী দিয়ে লড়ব? আমার যে একটা বন্দুকও নেই।”
“বন্দুক! হাঃ হাঃ! বন্দুক কেন, কামান বা অ্যাটমবোমাও রামরাহার কাছে কোনও অস্ত্রই নয়। ওসব ভেবে লাভ নেই। আমি অবশ্য একটা কাউন্টার এনার্জি ফিল্ড তৈরি করে দিচ্ছি। তার ফলে রামরাহার ট্রেসার প্রথম চেষ্টায় আমার অবস্থান ধরতে পারবে না। কিন্তু চালাকিটা বেশিক্ষণ টিকবে না।”
“আমার যে মাথায় কোনও বুদ্ধিও আসছে না।”
“ঠিক আছে। তুমিও ভাবো, আমিও ভাবি। একটা দুঃখের কথা তোমাকে এখনই বলে রাখি লাটু। আমি এখন তোমার হয়ে লড়ছি বটে। কিন্তু আমি তো আসলে যন্ত্র। যন্ত্রের কোনও পক্ষপাত থাকে না। রামরাহা যদি আমাকে হাতে পেয়ে যায়, তাহলে কিন্তু আমি তোমার বিরুদ্ধেই লড়াই করব।”
“বলো কী কাজি?”
“বললাম না, দুঃখের কথা! তাই বলি, হাতছাড়া কোরো না।”
৮. পাঞ্জাব মেল
পাঞ্জাব মেল মোগলসরাই স্টেশন সবে ছেড়েছে, এমন সময় ফার্স্ট ক্লাস কামরায় এক ভদ্রমহিলা আর্তনাদ করে উঠলেন, “আমার হারটা! ওগো, আমার হারটা যে ছিঁড়ে নিয়ে গেল! কী হবে!”
ভদ্রমহিলার স্বামী মাঝবয়সী নাদুস-নুদুস ভিতু চেহারার একজন লোক। তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, “নিয়ে গেল! অ্যাাঁ! কী সর্বনাশ! সোনার ভরি যে এখন প্রায় দু হাজার টাকা যাচ্ছে! চেন টানো! চেন টানো!”
উল্টোদিকে জানালার কাছ ঘেঁষে একজন লম্বাচওড়া যুবক চুপচাপ বসে ছিল এতক্ষণ। ঠিক চুপচাপ নয়, মাঝে-মাঝে সে একটা অদ্ভুত সুরে শিস দিচ্ছিন। যুবকটি ছ ফুটের ওপর লম্বা, দারুণ স্বাস্থ্য এবং দেখতে ভীষণ রকম সুপুরুষ। সে একটা খবরের কাগজ পড়ার চেষ্টা করছে আর আড়ে-আড়ে দেখছে সবাইকে।
মাঝবয়সী ভদ্রলোক চেন টানার জন্য হাত বাড়িয়েছিলেন, যুবকটি হঠাৎ বলল, “গাড়ি থামালেও কি জিনিসটা পাবেন?”
লোকটা থমকে গিয়ে ইতস্তত করে বলে, “তা পাব না ঠিকই। বরং আড়াইশো টাকা জরিমানা গুনতে হবে। জেলটেলও হতে পারে। কিন্তু কিছু তো করতে হবে।”
যুবকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ট্রেন থামালে আমার অসুবিধা হবে। আমি একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি। তার চেয়ে ট্রেনটা চলুক, হার আমি এনে দিচ্ছি।”
“আপনি এনে দেবেন! বলেন কী? ট্রেন এখন স্পিড দিয়ে। দিয়েছে যে!”