লাটু খানিকক্ষণ ভাবল। হঠাৎ হাতে ধরা যন্ত্রটার দিকে নজর পড়ায় সে একটু নড়েচড়ে বসে। কাজিকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়ে যায়। তাই না? সমস্যা হল, কাজি বাংলা ভাষা বোঝে কি না এবং জবাবটাও বাংলায় দেবে কি না।
হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। অত ভাবনায় কাজ কী? জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।
লাটু কাজির ডায়ালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সব তো বুঝতে পারছ। এখন বলল তো কী করব?”
কাজির কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না।
লাটু তার টুলবক্স থেকে একটা ইলেকট্রিক তার বের করে একটু তামার সুতো ছিঁড়ে নিল, তারপর কাজির একটা সূক্ষ্ম ফুটোয় তারটা ঢুকিয়ে সামান্য চাপ দিয়ে আবার প্রশ্নটা করল। এবার আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল একটা।
কাজি ভারী বিরক্ত হয়ে বলে, “ভুল ফুটোয় চাপ দিয়েছ। একটা ত্রিভূজ মাকা ফুটো আছে দেখ। ওটায় তার ঢোকাও।”
হতভম্ব লাটু তা-ই করল।
এবার কাজি বলল, “মামাবাড়ি যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে পড়ো।”
লাটুর বিস্ময় আর ধরে না। বাস্তবিকই তার খেয়াল ছিল না যে, মামাবাড়ির নাম করে বেরিয়ে পড়া যায়। বেশি দূরও নয়। দুই স্টেশন। সেখানে একজন গুণী লোক চমৎকার লাটাই বানায়। সেই লাটাই আনতে যাওয়ার একটা কথাও ছিল বটে।
লাটু কাজিকে নিজের টুলবক্সে লুকিয়ে রেখে মায়ের কাছে। গেল।
“মা, আমি একটু মামাবাড়ি যাব।”
“মামাবাড়ি! হঠাৎ কী মতলব।”
“বাঃ, লাটাই আনতে যাওয়ার কথা ছিল না?”
মা আর বিশেষ আপত্তি করলেন না, শুধু বললেন, “দাদু আর ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করে তবে যাস।”
লাটু যখন দাদুর ঘরে গিয়ে ঢুকল তখন আলমারির দরজা হাট করে খোলা আর তার সামনেই বাসবনলিনী এবং হারানচন্দ্রের মধ্যে তুলকালাম হচ্ছে। বাসবনলিনী চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন, “ফের ঘড়ি হারিয়েছ আর বলছ আলমারিতে রেখেছিলে! রেখেছিলে তো গেল কোথায় শুনি! কী সুন্দর ঘড়ি! ঘড়িকে ঘড়ি, তার সঙ্গে আবার রেডিও লাগানো। আর কি সে জিনিস পাওয়া যাবে? পইপই করে বললাম–”
এই গোলমালের মধ্যেই লাটু দাদুকে জিজ্ঞেস করল, “যাই দাদু?”
হারানচন্দ্র বিরক্ত হয়ে বললেন, “যা না!”
লাটু ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করে, “যাই ঠাকুমা?”
“তাড়াতাড়ি ফিরিস ভাই।”
লাটু এক লাফে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। কয়েকটা জামাকাপড় গুছিয়ে একটা ব্যাগে ভরে নিল। পরদিন ভোরবেলা মামাবাড়ি যাওয়ার জন্য রওনা হয়ে সে গিয়ে গর্ডনের বাড়ির পাঁচিল টপকে ওয়ার্কশপে ঢুকে পড়ল।
গর্ডনের কুকুরগুলো জেগে উঠেছে বটে, কিন্তু সব কেমন যেন মোহাচ্ছন্ন অবস্থা, তাকে দেখেও গা করল না।
ত্রিভুজ মার্কা ফুটোয় তার ঢুকিয়ে লাটু কাজিকে বলল, “কুকুরগুলোকে চাঙ্গা করে তোলো। ওরা আমাদের পাহারা দেবে।”
একথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে কাজির ভিতরে একটা অদ্ভুত রিনরিনে শব্দ-তরঙ্গ উঠে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কুকুরগুলো সেই শব্দের প্রভাবে হঠাৎ চনমনে হয়ে লাফ দিয়ে উঠে চারদিকে প্রচণ্ড দৌড়োদৗড়ি শুরু করে দেয়। তারপর এসে লাটুকে ঘিরে ধরে প্রবলভাবে ল্যাজ নাড়তে থাকে।
লাটু গম্ভীর হয়ে কুকুরগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “বেশ ভাল করে চারদিক নজর রাখবি, বুঝলি! এখন যা।”
সঙ্গে-সঙ্গে কুকুরগুলো বেরিয়ে গিয়ে গোটা ওয়ার্কশপটাকে প্রায় ঘিরে ফেলে পাহারা শুরু করে দেয়।
লাটু এবার ওয়ার্কশপটা পরীক্ষা করে দেখে। গর্ডন সাহেবের এই বিটকেল ওয়ার্কশপে কাজের ও অকাজের হাজার রকম যন্ত্রপাতি রয়েছে। লাটু তার অধিকাংশই চেনে না। আছে নানারকম রাসায়নিক দ্রব্যও। গর্ডনসাহেব যে উড়কু মোটর সাইকেল তৈরি করছিল সেটা একটা বড়সড় মজবুত ডাইনিং টেবিলের ওপর দণ্ডায়মান। মোটর সাইকেলের গায়ে একটা প্লট দাঁড় করানো। তাতে চক দিয়ে লেখা ফুয়েল চার্জড।
অলমোস্ট রেডি ফর ফ্লাইং। ওনলি ওয়ান থিং মিসিং। অর্থাৎ সব কিছুই প্রস্তুত, মোটর সাইকেল উড়বার জন্য তৈরি। শুধু একটা জিনিসের অভাবেই সেটা হচ্ছে না।
কিন্তু জিনিসটা কী?
লাটু কাজির বিজ্ঞান-জিজ্ঞাসার ছিদ্রে তারটা ঢুকিয়ে সমস্যাটা জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, “জিনিসটা কী কাজি?”
কাজি বলল, “খুব দুর্লভ জিনিস নয়। রাসায়নিকের তাকে দ্যাখো, একটা নীল রঙের শিশি আছে। তার গায়ে লেখা ‘পয়জন’। খুব সাবধানে ফুয়েল ট্যাংকের মধ্যে ঠিক চার ফোঁটা ফেলে দাও।”
লাটু দিল। “এবার কী করব কাজি?”
“সিটে উঠে বোসো। স্টার্টারে খুব আস্তে চাপ দাও। কোনও শব্দ হবে না, কিন্তু একটা জোর হাওয়া বেরোবে।”
“তারপর?”
“খুব সোজা। মোটর সাইকেলটা শূন্যে ভাসবে। বাঁ হাতের হাতলটা নিজের দিকে একটু ঘুরিয়ে দিলেই চলতে থাকবে। বেশি ঘোরালে স্পিড বাড়বে।”
লাটু খুব ভয়ে ভয়ে সিটে উঠে বসে স্টাটারে একটা পা ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতেই মোটর সাইকেলটা থরথর করে কেঁপে উঠল। একজস্ট পাইপ দিয়ে প্রবলবেগে হাওয়া বেরোনোর মৃদু শব্দ টের পেল সে। তারপরই প্রকাণ্ড মোটর সাইকেলটা ধীরে ধীরে শূন্যে উঠে ভাসতে লাগল।
“কাজি!” আতঙ্কে চেঁচায় লাটু।
“ভয় নেই। হাতলটায় চাপ দাও।”
লাটু অবাক ভাবটা সামলে নিতে কিছুক্ষণ সময় নিল। তারপর কাজির কথামতো কাজ করতেই মোটর সাইকেল ধীরে ধীরে শূন্যে চলতে থাকে। লাটুর চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া। এত অবাক হয়ে গিয়েছিল সে যে, সময়মতো দিক পরিবর্তন না করায় মোটর সাইকেলটা গিয়ে একটা দেয়ালে মৃদু ধাক্কা খায়।