“তাহলে কী করে তার সঙ্গে পারব?”
“আবার বলছি, ভয় পেও না। ভয় পেলে বুদ্ধি স্থির থাকে। আমাদের ধারণা, সে এখন তোমাদের কোনও সমুদ্রের গর্ভে তার মহাকাশযানে বিশ্রাম নিচ্ছে। হয়তো টুকটাক কিছু মেরামতও সেরে নিচ্ছে। তারপরই সে ওই যন্ত্রটার খোঁজে বেরোবে। যন্ত্রটা খুঁজে পেতে তার কোনও অসুবিধাই হবে না, কারণ ওই যন্ত্র সর্বদাই শক্তি বিকিরণ করছে আর তার কাছে আছে চমৎকার সন্ধানী যন্ত্র। তবে সে প্রথমেই দুম করে কিছু করে বসবে না। সে জানে, কোনও বিস্ফোরণ ঘটালে বা শব্দতরঙ্গ কিংবা রশ্মিযন্ত্র চালু করলে আমরা তার সন্ধান পেয়ে যাব, কাজেই সে স্বাভাবিক সব পন্থা নেবে। নানারকম বুদ্ধির চাল চালবে।”
“কিন্তু সে তো তাহলে জিতেই যাবে!”
“হয়তো জিতবে। তার তো জেতারই কথা। কিন্তু তোমার একটা বাড়তি সুবিধা আছে। সেটা হল তোমার হাতের ওই যন্ত্র। এই যন্ত্রকে তুমি সব কাজের কাজি বলতে পারো। আমাদের ভাষায় ওর নাম বুত বুত। তুমি ওটার নাম দাও কাজি। যদি বুদ্ধি স্থির রাখতে পারো আর ভয় না পাও, তবে কাজি তোমাকে নানা উপায় বলে দিতে পারবে। কাজির মধ্যে আছে অফুরন্ত মগজ আর অনন্ত উদ্ভাবনীশক্তি যা আমাদেরও নেই। সুতরাং কাজির কথামতো যদি চলো তবে রামরাহা তোমাকে সহজে হারাতে পারবে না। এখন তুমি একটা কাজ করো। যত শিগগির পারো, গর্ডন সাহেবের ওয়ার্কশপে গিয়ে ঘাঁটি করো।”
“গর্ডনের ওয়ার্কশপ! ও বাবা! সেখানে যে অনেক কুকুর।”
“তাতে কী? কাজি কুকুরদের এমন শাসন করে রাখবে যে, তারা তোমার বশংবদ হয়ে থাকবে। তারাই পাহারা দেবে তোমাকে।”
“আর গর্ডন সাহেবের পিসি? সে যে ভারী ঝগড়ুটে!”
“কাজি এমন ব্যবস্থা করবে যে, পিসি ভুলেও ওয়ার্কশপের ধারেকাছে যাবে না। কুকুরেরা তাকেও তাড়া করবে।”
“কিন্তু ওয়ার্কশপে কেন?”
“ওয়ার্কশপই যে দরকার। গর্ডনের ওয়ার্কশপ আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। খুবই সেকেলে মান্ধাতার আমলের ব্যবস্থা। তবে গর্ডন কিছু উদ্ভট চিন্তা করেছিল। তার ফলে কতগুলো যন্ত্র সে আধখ্যাঁচড়া তৈরি করেছে। তুমি সেগুলো সম্পূর্ণ করে নিতে পারো।”
“আমি? আমি তো বিজ্ঞান কিছুই জানি না।”
“চিন্তা নেই। কাজি তো আছেই। তুমি শুধু তার কথামতো চললেই হবে।”
“একা থাকব ওখানে?”
“একদম একা। কাউকে সঙ্গে নিও না।”
“বাড়িতে কী বলে যাব?”
“যাহোক একটা কিছু বোলো। আমাদের বাড়ি নেই, আত্মীয়স্বজন নেই। কাজেই তোমাদের ওসব সম্পর্কের কথা আমরা জানিই না।”
“তোমার মা বাবা দাদু নেই?”
লোকটা হাসল। বলল “আছে। কিন্তু আমরা তো তোমাদের মতো নই। আমরা অন্যরকম। সে কথা থাক। কাজটা কি শক্ত মনে হচ্ছে?”
“ভীষণ শক্ত, ভীষণ বিপজ্জনক।”
“মাত্র সাতটা দিন আমাদের সহায় হও। তোমাদের স্বার্থেই। রামরাহা তো পৃথিবীকে ধ্বংসও করতে পারে!”
লাটু একটু ভাবল, তারপর বলল, “চেষ্টা করব।”
“শাবাশ! এই তো চাই! কাজিকে সবসময়ে কাছে রেখো। খুব লক্ষ করলে দেখবে ওর নানা জায়গায় খুব সূক্ষ্ম ছিদ্র আছে। ভাল করে দ্যাখো।”
লাটু ঘড়িটা খুব ভাল করে উল্টেপাল্টে দেখল। খুব সূক্ষ্ম কয়েকটা ফুটো নজরে পড়ল তার। বলল, “আছে। দেখলাম।”
লোকটা বলল, “একটা সরু তারের মুখ বা ছুঁচ হাতের কাছে রেখো। একটা ফুটোর ওপরে একটা কাটাকুটি দাগ আছে, সেটাতে যদি ওই তার বা ছুঁচ ঢুকিয়ে চাপ দাও তাহলে কাজি তোমাকে নানা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া শেখাবে। যে ছ্যাঁদায় ঢ্যাঁড়া আছে, তা তোমাকে শেখাবে লড়াইয়ের পদ্ধতি। যে ছিদ্রটার গায়ে একটা গোল মাকা আছে তা যে-কোনও বস্তুকে খাদ্যে পরিণত করার বুদ্ধি দেবে। আরও আরও বহু গুণ আছে, কিন্তু সেগুলো তোমার জানার দরকার নেই। কাজিকে যেখানে রাখা হবে, তার আশপাশের অন্তত দেড়শো গজের মধ্যে একটা আলাদা অদৃশ্য শক্তির ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যাবে। আলোর প্রতিফলনে বাধা আসবে, ঘড়ি চলবে উল্টো দিকে। কাজেই উদ্ভট কিছু দেখে প্রথমেই ভয় পেও না।”
লাটু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বলল “ওঃ, তাই ওরকম সব হচ্ছিল!”
“এবার বুঝেছ?”
“হুঁ।“
“তাহলে লক্ষ্মী ছেলের মতো যা বলেছি কোরো। রামরাহাকে তুমি হারাতে পারবে না বটে, কিন্তু সাতটা দিন যদি তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারো, তাহলেই যথেষ্ট।”
“আপনি এখন কোথায় আছেন?”
“বললাম তো! অনেক দূরে। এখান থেকে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ওয়েভ বা আলো তোমাদের গ্রহে পৌঁছতে অনেক সময় নেয়।”
“তাহলে আপনার কথা আমি শুনতে পাচ্ছি কী করে?”
“এ হচ্ছে মেকানিক্যাল টেলিপ্যাথি। তোমরা বুঝবে না। যন্ত্রের সঙ্গে মানসিক ক্রিয়ার এক জটিল সমন্বয়। আমরা আলো বা ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ওয়েভের গতির চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতবেগে বার্তা পাঠাতে পারি।”
লাটু দেখল কাজির কাঁচ থেকে ছবিটা মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। লোকটা হাত তুলে বলল, “বিদায়। আবার দেখা হবে।”
“আপনার নাম কী?”
“খ্রাচ খ্রাচ। সাবধানে কাজ কোরো। ভয় পেও না। বুদ্ধি যেন স্থির থাকে।” বলতে বলতেই খ্রাচ গ্রাচের ছবি মিলিয়ে গেল। লাটু হতভম্ব হয়ে বসে ভাবতে লাগল, ঘটনাটা সত্যি না স্বপ্ন!
৭. গর্ডন সাহেবের ওয়ার্কশপে
গর্ডন সাহেবের ওয়ার্কশপে গিয়ে কয়েকদিন থাকা লাটুর পক্ষে খুব সহজ নয়। বাড়ি থেকে তাকে ছাড়বে কেন? যদি পালিয়ে যায়, তবে সাঙ্ঘাতিক হৈ-চৈ পড়ে যাবে, কান্নাকাটি শুরু হবে। সুতরাং পালানো উচিত নয়। তাহলে কী করা?