ঘড়ির উজ্জ্বল কাঁচটা ধীরে ধীরে হলুদ রং ধরল, ফের আস্তে আস্তে নীলচে হয়ে গেল, তারপর সাদাটে হতে লাগল।
লাটু হাঁ করে চেয়ে থাকে। একবার ভয়ে ঘড়িটা ফেলে দিতে যাচ্ছিল, সেই অশরীরী স্বর সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, “ফেলো না। তাকিয়ে থাকো। আমাকে দেখতে পাবে। ভয় নেই।”
“আপনি কে?”
“আমি? আমি একজন। চিনবে না।”
“আপনি কোথা থেকে কথা বলছেন?”
“অনেক দূর থেকে।”
“কত দূর?”
“সেটা তুমি ধারণাও করতে পারবে না।”
“আমি ভয় পাচ্ছি যে।”
“ভয় নেই। তুমি হবে আমার প্রতিনিধি।”
“প্রতিনিধি? কিসের প্রতিনিধি?”
“আমার প্রতিনিধি হয়ে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।”
“ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে বলছেন কেন?”
“আমাকে দেখতে পাবে। তাকিয়ে থাকে। আমার ছবি ফুটে উঠবে।”
লাটু তাকিয়ে থাকে। কয়েক সেকেন্ড বাদে ধীরে ধীরে ঘড়ির কাঁচে একটা মুখের আদল ফুটে উঠতে থাকে। ভারী অদ্ভুত মুখ। খুব লম্বা, গালভাঙা, কর্কশ একটা মুখ। চোখ দুটো গর্তের মধ্যে। মাথায় একটা হুডওলা টুপি কপাল ঢেকে আছে। মানুষেরই মুখ, তবে এরকম মুখ সচরাচর দেখা যায় না। অনেকটা আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো। তবে আরও ধারালো, আরও বুদ্ধিদীপ্ত। কিন্তু মুখটার মধ্যে একটা অমানুষিকতাও আছে।
লাটু ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে সম্মোহিতের মতো ঘড়ির পর্দায় চেয়ে থাকে।
ছবির মুখটা নড়ল এবং স্পষ্ট ও পরিষ্কার স্বর কানে এল লাটুর। “আমাকে দেখতে পাচ্ছ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“আমি তোমাদের ভাষা জানি না। আমি যে ভাষায় কথা বলছি সেটা কি তোমার ভাষা?”
“হ্যাঁ। আপনি বাংলা ভাষায় কথা বলছেন।”
লোকটা হাসল। বলল, “মোটেই নয়। আমি নিজের ভাষায় কথা বলছি। তবে একটা অনুবাদ্যযন্ত্র আমার সব কথা তোমার ভাষায় অনুবাদ করে দিচ্ছে। তোমাদের ভাষা শিখতে যন্ত্রটার বেশ সময় লেগেছে। এত বিদঘুঁটে ভাষা কেন তোমাদের?”
লাটু কী বলবে? সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুধু চেয়ে থাকে। লোকটা জিজ্ঞেস করল, “দাড়িওয়ালা ফর্সা আর লম্বা চেহারার যে লোকটার কাছে এ ঘড়িটা এর আগে ছিল, সে কে বলো তো!”
লাটু বলল, “গর্ডন সাহেব।”
“আর তার আগে লম্বা চুল আর দাড়িওলা লোকটা?”
“জটাই তান্ত্রিক।”
“ওরা কেমন লোক?”
“ভাল লোক।”
ছবির লোক্টা হাসল। বলল, “ওরা দুজনেই আমাদের এই ঘড়িটা খুলবার চেষ্টা করেছিল।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ। কিন্তু এটা খুব বিপজ্জনক। তুমি কখনও ঘড়িটা খুলবার চেষ্টা কোরো না। যদি করো তাহলে যন্ত্রই তার প্রতিশোধ নেবে। যেমন ওদের ওপর নিয়েছে।”
“ওদের কী হয়েছে?”
“খুব বেশি কিছু নয়। আমরা ওটাকে বলি যন্ত্র-সম্মোহন। আমাদের যন্ত্র ওদের সম্মোহিত করে রেখেছে। যতদিন সম্মোহন থাকবে, ততদিন ওরা আমাদের ভাষায় কথা বলবে, আমাদের যন্ত্র যেরকম তরঙ্গ সৃষ্টি করবে, সেই রকমই চিন্তা করবে। ওদের নিজস্ব সত্তা থাকবে না।”
“সম্মোহন কাটবে না?”
“কাটবে। সে ব্যবস্থা আমরা করব। চিন্তা কোরো না। কিন্তু তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।”
“বলুন।”
“আমাদের হয়ে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।”
“কী কাজ?”
“আমাদের একজন লোক আমাদের সঙ্গে দারুণ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ওই যে যন্ত্রটা তোমার হাতে রয়েছে, ওটা কিন্তু ঘড়ি নয়। অত্যন্ত জরুরি একটা যন্ত্র। বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য আবিষ্কার। ওই বিশ্বাসঘাতক যন্ত্রটি নিয়ে পালিয়ে যায়। সে গিয়ে তোমাদের পৃথিবীতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে বুঝতে পারছি, পৃথিবীতে নামবার সময় সে কোনও দুর্ঘটনায় পড়ে, এবং যন্ত্রটি তার হাতছাড়া হয়ে যায়। নানা হাত ঘুরে এখন ওটি তোমাদের হাতে এসেছে। আমরা যন্ত্রটা ফেরত চাই।”
লাটু অবাক হয়ে বলে, “বেশ তো, ফেরত নিন।”
ছবির লোকটা হাসল। বলল, “অত সহজ নয়। আমরা এখন মহাকাশের যেখানে রয়েছি, সেখান থেকে তোমাদের গ্রহে পৌঁছোতে অন্তত সাত দিন লাগবে। ততদিনে ওই দুষ্টু লোকটা চুপ করে বসে থাকবে না। সে পাগলের মতো যন্ত্রটা খুঁজে বেড়াচ্ছে।”
লাটু ভয় পেয়ে বলে, “তাহলে কী হবে?”
“তুমি কি খুব ভিতু?”
“আমি ছোট্ট একটা ছেলে তো! গায়ে বেশি জোরও নেই।”
“আমরা ছোট ছেলেই তো চাই। একাজ তোমাদের গ্রহের বড় মানুষেরা পারবে না। বড়দের মনে নানারকম সংশয়, সন্দেহ ইত্যাদি আছে। বাচ্চাদের ওসব নেই। এ কাজে আমরা তোমাকেই নিয়োগ করছি। মাত্র সাত দিন লোকটার চোখে ধুলো দিতে হবে। তোমাদের পৃথিবীর দিনরাত্রির হিসেবে সাতটা দিন।”
“লোকটা কী করতে চায়?”
“লোকটা ওই যন্ত্রটা দখল করতে চায়। একবার হাতে পেলেই সে আমাদের নাগাল এড়িয়ে পালিয়ে যাবে। সে নানারকম প্রযুক্তি আর যন্ত্রবিদ্যা জানে। অসম্ভব ধূর্ত এবং নিষ্ঠুর। সে যে মহাকাশযানটি নিয়ে পালিয়ে গেছে সেটিকে সম্ভবত তোমাদের কোনও সমুদ্রের গর্ভে লুকিয়ে রেখেছে। আমাদের সন্ধানী শব্দতরঙ্গ দিয়ে কিছুতেই সেটার হদিস করতে পারিনি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, পৃথিবীতে নামবার সময় সে কোনও দুর্ঘটনায় পড়েছিল। ফলে ওই মহামূল্যবান যন্ত্রটা তার হাতছাড়া হয়। কিন্তু দুর্ঘটনা খুব গুরুতর নয়। সে বেঁচে আছে।”
“লোকটার নাম কী? দেখতে কেমন?”
“তার নাম অবশ্য সে পাল্টে ফেলেছে। তবে আমরা তাকে রামরাহা বলে ডাকি। দেখতে অনেকটা আমার মতো। কিন্তু সে ইচ্ছেমতো চেহারা পাল্টাতে পারে। তবু বলে রাখি, তোমাদের হিসেবে সে প্রায় ছ ফুট লম্বা। স্বাস্থ্য ভাল। সে ঘণ্টায় একশো মাইল বেগে দৌড়োতে পারে। দশ ফুট উঁচু লাফ দিতে পারে, তোমাদের গ্রহের গড়পড়তা মানুষদের দশজনকে সে একাই কাবু করতে পারে। ব্রুস লি বা মহম্মদ আলি তার কাছে কিছুই নয়। কিন্তু এসব তেমন বিপজ্জনক নয়। তার কাছে যে মারণাস্ত্র আছে, তা দিয়ে সে পৃথিবীকে একেবারে গুঁড়ো-গুঁড়ো করে দিতে পারে। তা ছাড়া তার বুদ্ধি ক্ষুরধার, বিজ্ঞান সে ভালই জানে। যে-কোনও বস্তুর অণুর গঠন বদলে দিয়ে সে অন্য বস্তু তৈরি করতে পারে। মাটিকে সোনা, জলকে পেট্রল বানানো তার কাছে ছেলেখেলা। তার কাছে আছে বিবিধ রশ্মি-যন্ত্র। অর্থাৎ সে নিজের চারধারে এমন রশ্মি সৃষ্টি করতে পারে যাতে তোমরা তাকে দেখতে পাবে, কিন্তু সে তোমাদের স্পষ্ট দেখতে পাবে। তোমাদের যেসব সেকেলে অস্ত্রশস্ত্র আছে, অর্থাৎ বন্দুক, রিভলভার, মেশিনগান বা বোমা সেগুলো তার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। তোমাদের তুলনায় সে অতিমানুষ। শারীরিক গঠন, বুদ্ধি, ক্ষিপ্রতা কোনওটাতেই তোমাদের কেউ তার একশো ভাগের এক ভাগও নও। যন্ত্রবিদ্যায় তোমরা তার হাঁটুর সমান।”