বিকেলে হারানচন্দ্র হাসপাতালে দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আরও অবাক। পাশাপাশি দুটো বেডে জটাই আর গর্ডন বসে আছে। দুজনেরই মুখে হাসি। তারা পরস্পরের সঙ্গে খুব নিবিষ্টভাবে কথাবার্তা বলছে।
হারানচন্দ্র কাছে গিয়ে শুনলেন জটাই বলছে, “রামরাহা। খ্রাচ খ্রাচ।“
গর্ডন জবাব দিল, “রাডাক্যালি। খুচ খুচ।” দুজনের কেউই হারানচন্দ্রকে বিশেষ পাত্তা দিল না। হারানচন্দ্রের মাথাটা ঘুরছিল। কোনওরকমে সামলে নিয়ে তিনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলেন।
৬. দাদু ঘড়ি নিয়ে ফিরেছে
দাদু ঘড়ি নিয়ে ফিরেছে, এতে লাটু নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। ঘড়িটা সম্পর্কে তার কৌতূহল বরং দশগুণ বেড়েছে। নিত্য দাসের কথায় একটু আভাস পেয়েছিল লাটু। তারপর জটাইদাদুর থানে যে কাণ্ড দেখল, তা কহতব্য নয়। সেখানে চুরুটের গন্ধ ছিল। অর্থাৎ জটাইদাদুর কাছে গর্ডনসাহেব গিয়েছিল অবশ্যই। এর পরই খবর পাওয়া গেল, গর্ডনসাহেব তার কুকুরগুলো সমেত অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ওয়ার্কশপে। সবচেয়ে বড় কথা হল, এইসব রহস্যজনক কাণ্ডের সঙ্গে ঘড়িটার কোথাও একটা যোগসূত্র থেকেই যাচ্ছে।
সুতরাং লাটু তক্কে তক্কে ছিল। আড়াল থেকে সে দাদু আর ঠাকুমার কথা সবই শুনেছে। দাদু যে ঘড়িটা লোহার আলমারিতে রেখে চাবি কোমরে গুঁজল, এটাও সে লক্ষ করেছে। অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর এখন ইস্কুলে লম্বা ছুটি। দুপুর আর কাটতেই চায় না। তবু মটকা মেরে পড়ে থেকে সে দুপুরটা কাটাল। হারানচন্দ্র যখন বিকেলে বেরোনোর জন্য তৈরি হতে উঠলেন, তখন সেও উঠে পড়ল।
একটা সুবিধে হল এই যে, হারানচন্দ্রের বড় ভুলো মন। কাপড় বদলানোর সময় চাবির গোছাটা যে টেবিলে রাখলেন, সেটা পরক্ষণেই বেমালুম ভুলে গেলেন। সুতরাং দাদু বেরিয়ে যাওয়ার পর লাটু গিয়ে টেবিলের ওপর চাবিটা পেয়ে আলমারি খুলে ঘড়িটা বের করল।
ঘড়িটা বেশ বড়সড়। সাধারণ ঘড়ির মতো নয়। দেখতে ভারী বিদঘুঁটে। বারোটার জায়গায় চব্বিশটা ঘর। তাছাড়া ডায়ালের ওপর আরও কয়েকটা ছোট ডায়াল এবং কাঁটা রয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও সময়টা ধরতে পারল না লাটু।
কোনও রহস্যময় কারণে বাড়ির সব ঘড়িই দুপুর থেকে উল্টোবাগে চলছে। লাটুর দুই কাকা রজোগুণহরি আর বহুগুণহরি বার বার ঘড়িতে দম দিয়ে এবং মিলিয়ে কিছুই করতে পারছে না। শুধু দাদুর এই ঘড়িটা ঘড়ির মতোই সমানে চলছে বটে, কিন্তু ঘর বেশি থাকায় সময় ধরা যাচ্ছে না।
লাটুর একটা নিজস্ব টুলবক্স আছে। তাতে খুদে স্কু-ড্রাইভার, উকো, হাতুড়ি নানারকম যন্ত্রপাতি। বাক্সটা নিয়ে লাটু সোজা গিয়ে ঢুকল বড়কাকার ডার্করুমটায়।
ডার্করুমে ঢুকে লাটু দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর বাতি জ্বালানোর সুইচের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু মজা হল, দরজা বন্ধ করার পর ডার্ক রুম যেরকম ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার কথা, তেমন অন্ধকার হয়নি। বেশ স্নিগ্ধ একটা আলোয় ঘরের সব কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
লাটু সুইচ টিপতে হাত বাড়িয়ে অবাক হয়ে থেমে চারদিক চেয়ে দেখতে থাকে। এই ডার্করুমে সে প্রায়ই ঢোকে এবং কাকার ফোটোগ্রাফির অনেক কাজে সাহায্য করে। কাজেই ঘরটা তার খুবই পরিচিত। এত আলো এ-ঘরে থাকার কথা নয়। এরকম আলোও লাটু কখনও দেখেনি।
চোখ কচলে লাটু ফের ভাল করে তাকাল। চারদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করল। আসলে আলোটা কীরকম তা সে বুঝতে পারল না। সূর্যের আলোর রং সাদা, ফ্লুরোসেন্ট বাতির রং নীলাভ, বাবের আলো হলুদরঙা। কিন্তু এই আলোটার কোনও রং নেই। এমন কী, আলোটা যে জ্বলছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এক আশ্চর্য কার্যকারণে ঘরের প্রত্যেকটা জিনিসই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
লাটু অবাক হল, একটা ভয়-ভয়ও করতে লাগল। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করে।
হঠাৎ খুব কাছ থেকে কে যেন বলে ওঠে, “ওরা সব পাজি লোক। ওরা সব পাজি লোক।”
লাটু এত চমকে ওঠে যে, হাত থেকে ঘড়িটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। ভাল ক্রিকেট খেলে বলে এবং কখনও ক্যাচ ফশকায় না বলে পড়ো-পড়া ঘড়িটাকে ফের ধরে ফেলল সে। তারপর তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরোনোর চেষ্টা করতে গেল।
খুব মোলায়েম গলায় কে যেন ফের বলে ওঠে, “ভয় পেও। তোমার সঙ্গে কথা আছে।”
লাটুর বুকের ভিতরটায় দমাস-দমাস শব্দ হতে থাকে। গলা শুকিয়ে যায়। সে-চারদিকে চেয়ে কাউকেই দেখতে পায় না। হাত-পা ঝিমঝিম করছে ভয়ে। সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
অশরীরী গলার স্বর ফের বলে ওঠে, “দরজার ছিটকিনিটা তুলে দাও।”
লাটুর হাত-পা যদিও ভয়ে কাঁপছে, তবু তার মনে হয়, এই আদেশ পালন না করলেই নয়। সে লক্ষ্মী ছেলের মতো ছিটকিনিটা তুলে দেয়।
ফের আদেশ হয়, “চেয়ারে বোসো।”
লাটু ডার্করুমের কাঠের চেয়ারটায় কাঠের পুতুলের মতোই বসে পড়ে।
“এবার ঘড়িটার দিকে তাকাও।”
লাটু হাতে ধরা ঘড়িটার কথা একদম ভুলে গিয়েছিল। ঘড়িটা তার মুঠোতেই ধরা রয়েছে। সে মুঠো খুলে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ভারী অবাক হয়ে যায়। ঘড়ির মস্ত ডায়ালটার চেহারা একদম পাল্টে গিয়েছে। কাঁটাগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। ঘড়ির কাঁচটা একদম ঘষা কাঁচের মতো অস্বচ্ছ। তবে কাঁচটা খুব উজ্জ্বল।
লাটু ঘড়িটার দিকে মুখ নিচু করে চেয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন নিবিষ্ট হয়ে পড়ে। তার মনে হয়, এক্ষুনি একটা কিছু ঘটবে। কী ঘটবে তা সে অবশ্য জানে না।