হারানচন্দ্র বাড়ি ফিরতে ফিরতে নানা কথা চিন্তা করছিলেন। আচমকাই তাঁর কানের কাছে কে যেন খুব অমায়িকভাবে বলে উঠল, “রামরাহা। নানটাং। রামরাহা।”
আপাদমস্তক চমকে উঠলেন হারানচন্দ্র। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না। ডান ধারে মজা খালের সোঁতা। বাঁ ধারে গর্ডন সাহেবের বাড়ির পাঁচিল। রাস্তা যতদূর দেখা যাচ্ছে ফাঁকা এবং জনশূন্য।
হারানচন্দ্র তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলেন। কিন্তু আচমকাই কে যেন কাছ থেকে ধমকে উঠল, “রামরাহা! খ্রাচ খ্রাচ! খুচ খুচ!”
বাঁ ধারে গর্ডন সাহেবের বাড়ির ফটক। যারা জানে, তারা কদাচ হুট বলতে ফটক পেরোয় না। কারণ বাগানে সর্বদা
দশ-বারোটা বিভীষণ চেহারার কুকুর পাহারা দিচ্ছে। ঢুকলেই ফেচিখেউ করে ধরবে এসে।
কিন্তু হারানচন্দ্রের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে। “রাম রাম রাম রাম” জপ করতে করতে তিনি ফটকটা এক ধাক্কায় খুলে ভিতরে ঢুকে প্রাণপণে চেঁচাতে লাগলেন, “গর্ডন! ও গর্ডন! বাঁচাও!”
আশ্চর্য! আজ একটাও কুকুর তেড়ে এল না। নিঝুম বাড়ি। কারও কোনও সাড়া নেই।
হারানচন্দ্র আতঙ্কিত শরীরে দাঁড়িয়ে শুনলেন, বাতাসের মধ্যে ফিসফাস করে নানারকম কথাবার্তা হচ্ছে। ফটকটা বন্ধ করে হারানচন্দ্র অত্যন্ত দ্রুতবেগে গর্ডনের ওয়ার্কশপের দিকে দৌড়াতে লাগলেন।
বেশি দূর নয়। বাগানের পুবদিকের পাঁচিল ঘেঁষে মস্ত টানা একটা. দোচালা। হারানচন্দ্র গিয়ে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল।
ভিতরে নানা বিটকেল যন্ত্রপাতি। একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের গামলায় চাকা আর মোটর লাগিয়ে গামলা-মোটরগাড়ি বানিয়েছে গর্ডন মোটর-সাইকেলটাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, একটা কলের মানুষ তৈরি করছে গর্ডন, সেটাও অর্ধেকটা তৈরি। হাতুড়ি, ছেনি, বাটালি, হাপর থেকে শুরু করে নানারকম বৈদ্যুতিক যন্ত্র, রাসায়নিক দ্রব্য, কিছুরই অভাব নেই। এই যন্ত্রের জঙ্গলে ঢুকলে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতে হয়।
হারানচন্দ্র হাঁফাচ্ছিলেন। চার দিকে চেয়ে হাঁক মারলেন, “গর্ডন! বলি, গর্ডন আছ নাকি?”
সাড়া নেই। আচমকা হারানচন্দ্র নীচের দিকে চেয়ে চমকে উঠলেন। পায়ের কাছে মস্ত একটা ম্যাস্টিফ কুকুর ওত পেতে বসে আছে।
“ওরে বাবা!” বলে হারানচন্দ্র একটা লাফ মেরে একটা টুলের ওপর উঠে পড়লেন। টুলটা ঠকঠক করে নড়তে লাগল। হারানচন্দ্র চোখ বড় বড় করে আতঙ্কিতভাবে কুকুরটার দিকে চেয়ে রইলেন। কিন্তু কুকুরটার নড়াচড়ার লক্ষণ দেখা গেল না। বহুক্ষণ লক্ষ করে হারানচন্দ্র বুঝলেন, কুকুরটা জেগে নেই। কিন্তু এত গাঢ় ঘুম কুকুরের কখনও হয় না। শব্দ হলে তো কথাই নেই, অচেনা গন্ধেই কুকুর ঘুম ভেঙে লাফ দিয়ে ওঠে। ম্যাস্টিফটা কি তাহলে মরে গেছে?
হারানচন্দ্র টুল থেকে নেমে নিচু হয়ে কুকুরটার গায়ে হাত রাখলেন। না, কোনও স্পন্দন নেই। নিচু হয়ে হারানচন্দ্র অতঃপর চারদিকে চেয়ে দেখলেন। তাঁর চক্ষু স্থির হয়ে গেল। টুলের নীচে, বেঞ্চির তলায়, টেবিলের ছায়ায় দশ-বারোটা কুকুর পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে আছে। সামনের দুই থাবার মধ্যে নামানো মাথা। হুবহু ঘুমন্ত ভাব। কিন্তু ঘুম নয়। তার চেয়ে গভীর কিছু।
হারানচন্দ্রের বুক কাঁপছিল ভয়ে। কুকুরগুলোর হল কী?
ওয়ার্কশপের এক কোণে গর্ডনের নিজস্ব বিশ্রামের জন্য একটা খোপ আছে। হারানচন্দ্র ধীর-পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলেন। কাছে গিয়ে একেবারে বাক্যহারা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন।
প্রথমেই নজরে পড়ল, টেবিলের ওপর তাঁর ঘড়িটা পড়ে রয়েছে। পাশেই একটা ছোট্ট ডাইস ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। ঘড়িটা বোধহয় খোলার চেষ্টা করেছিল গর্ডন। পারেনি। গর্ডনের টুলটা কাত হয়ে পড়ে আছে মেঝেয়। গর্ডন নিজে পড়ে আছে আর-একটু দূরে। চোখ ওল্টানো, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। সংজ্ঞাহীন না প্রাণহীন, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
ঘড়িটা নিয়ে হারানচন্দ্র ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলেন। তাঁর চেঁচামেচিতে বিস্তর লোক জমা হয়ে গেল। গর্ডনকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে।
হারানচন্দ্র বাড়ি ফেরার পর হৈ-হৈ পড়ে গেল। তাঁর হাতে ঘড়ি। ঘড়িটা যে ফের ফিরে আসবে, এটা কেউ আশা করেনি।
বাসবনলিনী বললেন, “ও ঘড়ি আর পরতে হবে না। এখন থেকে আমার কাছে থাকবে।”
হারানচন্দ্র বিরস মুখে বললেন, “তাই রাখো। ওই অলুক্ষুনে ঘড়ি আমি কাছে রাখতে চাই না।”
বাসবনলিনী অবাক হয়ে বললেন, “অলক্ষুনে কেন হবে? সত্য কলকাতা থেকে আদর করে কিনে এনে দিল, অলক্ষুনে কিসের?”
হারানচন্দ্রের দৃঢ় ধারণা, ঘড়িটা ভুতুড়ে। কিন্তু সে কথা বললে তাঁর মান থাকে না। তাই গম্ভীর মুখে বারান্দার ইজিচেয়ারে গিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলেন। তাঁর মনে হল, ভূত জিনিসটা সত্যিই আছে। এতদিন প্রমাণ না পেয়ে বিশ্বাস করেননি বটে, কিন্তু এবারে হাড়ে-হাড়ে টের পেতে হচ্ছে। কিন্তু ভয়ের কথা হল, ভূতটা ভয়ংকর শক্তিশালী। যে মানুষ ভূত চরিয়ে খায়, সেই জটাই তান্ত্রিক এই ভূতের পাল্লায় পড়ে পাগলা হয়ে আবোল-তাবোল বকছে। ঘড়িটা জটাইয়ের হাত থেকে কী করে গর্ডনের কাছে গেল সেটা তিনি জানেন না, কিন্তু ঘড়ির ভূত গর্ডনের মতো দশাসই জোয়ানকেও কাত করে ফেলেছে তার বিটকেল কুকুরগুলোসহ। এইরকম সাংঘাতিক ভুতুড়ে ঘড়ি বাড়িতে রাখাটা কি ঠিক হবে? বাসবনলিনী খুবই ডাকসাইটে মহিলা বটে, কিন্তু ভূতটাও কম ত্যাঁদড় তো নয়।