হারানচন্দ্র বন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলেন।
জটাই তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, “লুলু। রামরাহা, রামরাহা। খুচ খুচ। নানটাং। রিকি রিকি। বুত বুত।”
ডাক্তাররা চাপা গলায় হারানচন্দ্রকে জানালেন, “মাথাটা একদম গেছে। সাবধানে কথা বলবেন। কামড়ে দিতে পারে।”
হারানচন্দ্রের মুখ শুকিয়ে গেল। জটাইকে তিনি এমনিতেই পাগল বলে জানেন। তার ওপর আবার পাগলামির কী দরকার?
জটাই ধমকের স্বরে হারানচন্দ্রকে বললেন, “রামরাহা! রামরাহা! নানটাং। র্যাডাক্যালি।”
হারানচন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো বটেই। “
“খ্রাচ খ্রাচ!”
“হ্যাঁ, তাও বটে। তুমি একটু ঠাণ্ডা হও জটাই।”
জটাই হঠাৎ হোঃ হোঃ করে হাসতে লাগলেন।
হারানচন্দ্র একটু পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “হাসির কথা বলছ নাকি? তা ভাল, আমিও একটু হাসি তাহলে। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ…”
জটাই উঠে বসলেন। তারপর অত্যন্ত গম্ভীর মুখে ফিসফিস করে বললেন, “খুচ খুচ। লুলু। রামরাহা!”
হারানচন্দ্ৰ ভড়কে গিয়ে উঠে পড়লেন। বললেন, “সবই ঠিক কথা হে জটাই। সবই বুঝতে পেরেছি। আজ তাহলে আসি।”
হারানচন্দ্র রাস্তায় এসে হাঁটতে হাঁটতে খুবই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন। রামরাহা! ব্রাচ ব্রাচ! নানটাং! র্যাডাক্যালি! কথাগুলো এমনিতে অর্থহীন এবং অচেনা বটে। কিন্তু এর আগে ঠিক এইরকমই সব শব্দ তিনি যেন কোথায় শুনেছেন! কোথায়?
খুব সম্প্রতি শুনেছেন বলেই মনে হচ্ছে।
হাসপাতালের সামনে একটা মস্ত শিশুগাছের তলায় নিত্য দাস বসে ছিল। মুখ শুকনো। চোখের দৃষ্টি ভারী ছলছলে।
হারানচন্দ্রকে দেখে নিত্য দাস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “জয় কালী কলকাত্তাওয়ালি, জয় শিবশন্তো?”
হারানচন্দ্র চমকে উঠে বলেন, “তুই আবার কবে থেকে কালীভক্ত হলি?”
“আজ্ঞে, সবই প্রভুর কৃপা। তা প্রভুকে কেমন দেখলেন?”
“ভাল নয় রে। মাথা খারাপের লক্ষণ।”
নিত্য দাস হাসল না। তবে গম্ভীর হয়ে খুব দৃঢ় স্বরে বলল, “আজ্ঞে, ওসব ডাক্তারদের চালাকি। প্রভুর সমাধি অবস্থা চলছে।”
“সে আবার কী?”
“আপনি নাস্তিক মানুষ, ঠিক বুঝবেন না।”
“সমাধি কী জিনিস সে আমি জানি। সবই বুজরুকি। তা জটাইয়ের সে-সব হয়নি। উদ্ভট সব কথা বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে।”
“তা তো বেরোবেই। দেবতারা সব এ সময়ে কথা বলেন তো ওঁদের মুখ দিয়ে। তা কী বলছেন প্রভু?”
“অদ্ভুত সব শব্দ। নানটাং, রামরাহা, র্যাডাক্যালি…”
“অ্যাাঁ! বলেন কী! এ যে আমি নিজের কানে কালকেই ভূতেদের বলতে শুনেছি। প্রভুর কাছে বসে ছিলাম সকালে, ভূতপ্রেতরা সব জুটল এসে চারধারে। দারুণ মাইফেল।”
“তুইও শুনেছিস!”
“আজ্ঞে, একেবারে স্বকর্ণে। বাঞ্ছারাম, বাঞ্ছাসীতা আর তাদের সাকরেদরা ওই ভাষাতেই কথা বলে কিনা।”
কথাটা হারানচন্দ্রের খুব অবিশ্বাস হল না। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, সেদিন রাত্রে ঘড়ি বালিশের তলায় নিয়ে শুনেছিলেন। তখন সারা রাত যে সব অশরীরী কথাবাতা তাঁর কানে এসেছে, তার মধ্যে এইসব অদ্ভুত শব্দ ছিল বটে।
হারানচন্দ্র অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, “রাম রাম। কী যে ভুতুড়ে কাণ্ড শুরু হল!”
নিত্য দাস হঠাৎ ‘জয়কালী’ বলে হারানচন্দ্রের পায়ের গোড়ায় উপুড় হয়ে বসে মাথা নাড়তে লাগল। “কী বললেন! রাম রাম! এ যে ভূতের মুখে রামনাম গো কতা! অ্যাাঁ। ঘোর নাস্তিকও প্রভুর মহিমায় রামনাম করতে লেগেছে! উঃ রে বাবা, এ যে একেবারে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছেন প্রভু!”
হারানচন্দ্র লজ্জা পেয়ে বললেন, “দূর বোকা! রাম রাম কি আর ভূতের ভয়ে করেছি নাকি? রাম রাম বলেছি ঘেন্নায়। তা সে যাই হোক, জটাল্টা খুব ভাবিয়ে তুলেছে।”
নিত্য দাস মাথা নেড়ে বলে, “কোনও ভয় নেই। আমি বলছি প্রভুর এখন সমাধি চলছে। পিশাচ ভাব। সমাধিটা কেটে গেলেই দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।”
হারানচন্দ্র হাঁটতে হাঁটতে কী একটু ভেবে জটাইয়ের বাসার দিকে চলতে লাগলেন। যত নষ্টের মূল সেই ঘড়িটা তাঁকে আর একবার ভাল করে দেখতে হবে। জটাই যখন ভূতের গল্পটা বলেছিল, তখন তাঁর ভাল বিশ্বাস হয়নি বটে, কিন্তু এখন নানা ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তাঁর মনে হচ্ছে, ঘড়িটা বিশেষ পয়া নয়।
জটাই তান্ত্রিকের ভগ্ন্যুপের মতো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একটু দ্বিধা বোধ করলেন হারানচন্দ্র। একদম একা ঘড়িটার কাছে যেতে এই দিনের বেলাতেও তাঁর সাহস হচ্ছিল না।
কিছুক্ষণ দোনোমোনো করে তিনি অবশ্য ঢুকলেন। উঠোন পেরিয়ে ঘরে উঁকি দিলেন। জটাইয়ের ঘর তালা দেওয়া থাকে না। কারণ দামি জিনিস বলতে কিছুই প্রায় নেই। একটা কুটকুটে কম্বলের বিছানা, একটা ঝোলা, কমণ্ডল, ত্রিশূল এইসব রয়েছে।
সন্তর্পণে ঘরে ঢুকলেন হারানচন্দ্র। তারপর ঘড়িটা খুঁজতে লাগলেন।
কিন্তু কোথাও ঘড়িটা পাওয়া গেল না। এমন কী, হরি ড্ডামের করোটির ভিতরেও নয়।
হারানচন্দ্রের মুখ শুকিয়ে গেল। ঘড়ি হারানোয় তাঁর বড় বদনাম। জটাই তান্ত্রিক পাগল হয়ে গেছে, তার ঘরে ঘড়িটা নেই। সুতরাং এটাও হারিয়েছে বলেই ধরে নেবে লোকে। বাসবনলিনী যে কী কাণ্ড করবেন কে জানে।
হারানচন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলেন। এ ঘড়িটা হারানোয় তিনি খুব একটা দুঃখ বোধ করছেন না। হারিয়ে থাকলে একরকম ভালই। আপদ গেছে। কিন্তু বাসবনলিনী তো কোনও ব্যাখ্যাই শুনতে চাইবেন না। দুঃখ এইটাই।