“সত্যি! ও মাগো!” বলে কদম নিত্য দাসকে জাপটে ধরে। নিত্য দাস তাকে কোলে নিয়ে হেসে বলে, “ভয় কী দিদি? জটাইবাবার মহিমায় ভূতেরা সব চাকরবাকর হয়ে আছে। ভূতে গান গাইছে, ভূতে বাসন মাজছে, ভূতে বাবার পা দাবাচ্ছে। ওঃ, সে যা দৃশ্য!”
লাটু চাপা গলায় বলল, “গুল!”
নিত্য দাস মাথা চুলকে বলল, “হ্যাঁ, গুলও দিচ্ছে তারা। নিজের চোখে দেখলাম, কয়লার গুঁড়ো, গোবর আর মাটি মেখে
এত বড় বড় গুল দিচ্ছে রোদে বসে।”
লাটু বলল, “আর মিথ্যে কথা বোলো না নিত্যদা। ভূত তুমি মোটেই দেখনি।”
নিত্য দাস কথাটা না শোনার ভান করে হঠাৎ হুংকার দেয়, “জয় কালী কলকাত্তাওয়ালি। জয় শিবশম্ভো!”
ছানু লাটুর দিকে চেয়ে বলে, “দাদুর মতো তুইও সব কিছু উড়িয়ে দিস। জটাইদাদুর একটা ভূত তো আছেই। বাঞ্ছারাম।”
“ওটাও গুল।”
নিত্য দাস জিব কেটে বলে, “সে কী কথা! বাবার মুখ দিয়ে জীবনে একটাও মিথ্যে কথা বেরোয়নি। বাঞ্ছারাম তো আছেই, বাঞ্ছাসীতাও আছে। নিজের চোখে দেখেছি।”
লাটু চোখ পাকিয়ে বলে, “কী দেখেছ? আমরা গিয়ে যদি
তাদের দেখা না পাই, তাহলে কিন্তু ভাল হবে না নিত্যদা!”
নিত্য দাস এক গাল হেসে কদমকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, “দেখা পাবে বই কী! তবে দেখার চোখ চাই। প্রথমটায় আমি বুঝতে পারিনি কিনা।”
লাটু বলল, “সে কী রকম?”
নিত্য দাস বলে, “কাউকে বোলো না কিন্তু। ব্যাপারটা হল বাবার থানে সকালে গিয়ে একটু বসেছি, হঠাৎ কারা যেন কাছেপিঠে কথাবার্তা বলতে শুরু করল। কিন্তু কাউকে দেখছি না। স্পষ্ট শুনছি একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ভুতুড়ে ভাষায় কথা বলছে। নিরিখ পরখ করে বুঝলাম, কথাবার্তা হচ্ছে ঘড়ির ভিতর।”
“ঘড়ির ভিতর?” তিনজনে একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে।
“তাহলে আর বলছি কী? কিন্তু সে-ঘড়িও যে-সে ঘড়ি নয়। পাক্কা ভুতুড়ে বিটকেল এক ঘড়ি। ঠাহর করে দেখলাম ঘড়ির দুটো কাঁটাই কথাবার্তা বলছে। তখন বুঝতে আর অসুবিধে হল না, বাবা যোগবলে বাঞ্ছারাম আর বাঞ্ছাসীতাকে ঘড়ির দুটো কাঁটা করে রেখে দিয়েছেন। বড় কাঁটাটা বাঞ্ছারাম, ছোটটা তার বউ বাঞ্ছসীতা।”
লাটু ধমকে ওঠে, “ঘড়িটা কি জটাইদাদুর কাছে আছে?” নিত্য দাস এক গাল হেসে বলে, “তবে আর কোথায়? সে এক অশৈরি ঘড়ি ভাই। আসল ঘড়ি তো নয়। স্বয়ং শিব বাবার তপস্যায় খুশি হয়ে নিজে এসে দিয়ে গেছেন। “
তিন ভাইবোনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। লাটু উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, “ঘড়ি তাহলে জটাইদাদুর কাছে!”
কদম বলল, “দাদু মিথ্যে কথা বলেছে।”
ছানু বলল, “দাদু গুল মেরেছে।”
লাটু কটমট করে ভাইবোনের দিকে চেয়ে থেকে একটা ধমক দিল, “চোপ! গুরুজন সম্পর্কে শ্রদ্ধা রেখে কথা বলবি।”
নিত্য দাস ভিক্ষে নিয়ে বিদেয় হওয়ার পরেই তিন ভাইবোনে জটাই তান্ত্রিকের বাড়ি রওনা হল।
সন্ধে হয়ে এসেছে। শহরের একেবারে ধারে নির্জন জায়গায় গাছগাছালিতে ঘেরা জায়গাটায় এলেই কেমন গা-ছমছম করে। একটু দূরেই নদী। নদীর ধারে শ্মশান। সন্ধের মুখে গাছগাছালি পাখিতে ভরে গেছে। পাখিদের ডাক ও ঝগড়ার শব্দে জায়গাটা যেন আরও ছমছম করছে।
জটাই তান্ত্রিকের বাড়ি খুবই পুরনো। আসল বাড়িটা খুব বড় ছিল। এখন কয়েকটা থাম আর নোনাধরা দেয়াল ছাড়া বাকিটা ধ্বংসস্তূপ। তার মধ্যেই দু’খানা ইটের ঘর কোনওরকমে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে মস্ত উঠোন। উঠোনে কয়েকটা বেলগাছ।
তিনজনে খুব সন্তর্পণে আগড় ঠেলে উঠোনে ঢুকল। কেউ কোথাও নেই।
লাটু ডাকল, “জটাইদাদু! ও জটাইদাদু!” কেউ সাড়া দিল না। ছানু ভয়ে-ভয়ে বলল, “জটাইদাদু বোধহয় বাড়ি নেই। চল, পালিয়ে যাই।”
লাটু খিঁচিয়ে উঠে বলে, “নেই তো ঘরের দরজা খোলা কেন?”
কদম বলে, “হয়তো জটাইদাদু ধ্যানট্যান করছে।”
লাটুরও একটু ভয়-ভয় করছিল। কিন্তু ভাইবোনের সামনে সেটা পাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে, সেই ভয়ে সে গটগট করে গিয়ে ঘরে ঢুকল। তারপরই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
জটাই তান্ত্রিক ঘরের মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। জ্ঞান নেই। কিংবা মারাও গিয়ে থাকতে পারেন।
লাটু ভয় পেলেও চেঁচাল না। চারদিক চেয়ে দেখতে লাগল। আচমকা সে বাতাসে একটা কড়া চুরুটের গন্ধ পায়।
গর্ডন যে সব সময়েই চুরুট খায়, এটা সবাই জানে।
৫. তিন ভাইবোনের চেঁচামেচি
তিন ভাইবোনের চেঁচামেচি শুনে লোকজন ছুটে এল। অনেক জলের ঝাঁপটা, পাখার বাতাস, জুতোর সুকতলা আর পোড়া কাগজের গন্ধ শোঁকানো সত্ত্বেও জটাই তান্ত্রিকের জ্ঞান ফিরল না। ডাক্তার এসে স্মেলিং সল্টের শিশি ধরলেন নাকে। জটাই তান্ত্রিক তাতেও নড়লেন না। ডাক্তার চিন্তিত মুখে বললেন, “অসুখটা ঘোরালো মনে হচ্ছে। হাসপাতালে পাঠানো দরকার।”
জটাইয়ের অসুখের গোলমালে ঘড়ির ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল। লাটু আর কদম আর ছানুরও ঘড়ির কথা মনে রইল না।
হাসপাতালের ডাক্তাররা জটাইকে পরীক্ষা করে মাথা চুলকোতে লাগলেন। অসুখটা যে কী তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। হার্ট ঠিক আছে, নাড়ীও চলছে ঠিকভাবে, ব্লাডপ্রেশার স্বাভাবিক। তাহলে হলটা কী?
সারা রাত নানারকম চিকিৎসা চলল। ভোরের দিকে হঠাৎ জটাই চোখ মেলে তাকিয়ে বিড় বিড় করে এক অচেনা ভাষায় কথা বলতে লাগলেন। চোখ দুটোর দৃষ্টিও অস্বাভাবিক।