সেই থেকে লেগেই আছে পীতাম্বর।
.
বাঁশতলা জায়গাটা ভারী নিরিবিলি, সাধনভজনের পক্ষে খুবই উপযুক্ত। পীতাম্বর এই বাঁশতলাতে বসেই নিজেকে দৃশ্যমান করে তোলার জন্য ইচ্ছাশক্তিকে চাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। তার ফলও এই ফলতে শুরু করেছে। গোবিন্দ নামে লোকটা, কেউ পিছু নিয়েছে বলে যে সন্দেহ করল আর বোঁটকা গন্ধ পেল সে তো আর এমনি এমনি নয়। পীতাম্বরের সাধনারই ফল।
এরা দুজন কোথায় কী মতলবে যাচ্ছে তা পীতাম্বর ভালই জানে। ডানহাতি গলির শেষে সাতকড়ি শিকদারের বাড়ি। কিন্তু যাকে খুঁজতে যাচ্ছে সে ও-বাড়িতে যায়নি, পীতাম্বর তাও জানে। নবীন মুদি এদের ভুল ঠিকানা দিয়েছে। সাতকড়ি শিকদার ষাগুণ্ডা লোক, দু’বেলা মুগুর ভাঁজে। মেজাজও ভয়ঙ্কর। তা ছাড়া তার আরও এক ব্যারাম আছে। তারা তিন বন্ধুতে মিলে রাতের দিকে প্ল্যানচেট করতে বসে। সে সময়ে তাদের বিরক্ত করলে খুব চটে যায়। ওই প্ল্যানচেটের আসরে অনেক ঘুরঘুর করেছে পীতাম্বর, কিন্তু কারও ভেতরে সেঁধোতে পারেনি।
লোকগুলো ভুল ঠিকানায় যাচ্ছে বলে পীতাম্বরের একটু দুঃখ হচ্ছিল। আসলে গোবিন্দ নামে লোকটাকে তার বড্ড ভাল লাগছে। এ-লোকটাই তাকে প্রথম ভূত বলে টের পাচ্ছে তো, সেইজন্যই পীতাম্বর একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে।
লোক দুটো যখন ডানহাতি গলিটার মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছে, তখন পীতাম্বর তাদের সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকে বলল, “ওহে বাবারা, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। মানে-মানে ফিরে যাও, নইলে বেঘোরে পড়ে যেতে হবে যে, মুদির পো মহা পাজি লোক, তোমাদের ভুল ঠিকানা দিয়েছে।”
গোপাল আর গোবিন্দ অবশ্য পীতাম্বরকে ভেদ করেই ঢুকে পড়ল গলিতে। আর ঢুকেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াল গোবিন্দ। চাপা গলায় বলল, “একটা গলার স্বর শুনলে নাকি গোপালদা?”
গোপাল চটে উঠে বলে, “কীসের স্বর বললি?”
“আহ, চটো কেন? কেউ কিছু বলছে বলে মনে হল না ভোমার?”
“তোর কি মাথা খারাপ? জনমনিষ্যিহীন গলি, এখানে কথা কইবে কে? কইলে আমি শুনতে পেতুম না?”
“কিন্তু আমি যে শুনলাম?”
“কী শুনলি?”
“ভাল বোঝা গেল না। মনে হল কেউ যেন আমাদের গলিতে ঢুকতে বারণ করছে।”
পীতাম্বর আনন্দে আত্মহারা হয়ে দুহাত তুলে নাচতে নাচতে গেয়ে উঠল, “সারা-রা-রা-রা, মার দিয়া কেল্লা।”
গোবিন্দ পাংশু মুখে বলল, “কে গান গাইছে বলে তো গোপালদা?”
“গান গাইছে? বলিস কী?”
“খুব আস্তে শোনা যাচ্ছে বটে, কিন্তু গাইছে ঠিক। অনেকটা যেন মশার গুপ্ত শব্দের মতো।”
“কী গাইছে?”
“মার দিয়া কেল্লা না কী যেন।”
গোপাল গম্ভীর হয়ে বলল, “এ তো মস্তিষ্ক বিকৃতির রাজলক্ষণ দেখছি! শোন গোবিন্দ, কাজটা নামিয়ে দে, তারপর ফিরে গিয়েই তোকে হরিহর কবরেজের কাছে নিয়ে যাব। মাথার তালুটা চৌকো করে কামিয়ে হরিহর কবরেজ যে মধ্যমনারায়ণ তেল দিয়ে পুলটিস চাপিয়ে দেয় তাতে বহু পুরনো পাগলও ভাল হয়ে যেতে দেখেছি।”
“না গোপালদা, এ মোটেই পাগলামি নয়। কিছু একটা হচ্ছে।”
পীতাম্বর সোল্লাসে বলে উঠল, “হচ্ছেই তো! খুব হচ্ছে। তা গোবিন্দভায়া তোমার ওপর বড় মায়া পড়ে গেছে বলেই বলছি, সেই বুড়ো ভামটিকে এখানে পাবে না। সে গিয়ে বিপিনবাবুর বাড়িতে উঠেছে।”
গোবিন্দ আঁতকে উঠে বলল, “ওই আবার?”
“আবার কী? নতুন গান নাকি?”
“না, কী যেন বলছে। ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“একটা কাজ করবি গোবিন্দ? একটু মাটি তুলে দুটো টিপলি বানিয়ে দুই কানে চেপে ঢুকিয়ে দে। তা হলে আর ঝঞ্জাট থাকবে
পীতাম্বর চেঁচিয়ে উঠল, “না, না, খবরদার না।”
গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলে, “শিশিরে ভেজা ঠাণ্ডা মাটি কানে দিলে আর দেখতে হবে না, কানের কটকটানি শুরু হয়ে যাবে। তার চেয়ে এক কাজ করি গোপালদা।”
“কী কাজ?”
“এসব ভূতুড়ে কাণ্ড না হয়েই যায় না। আমি বরং রামনাম করি। কী বলে?”
গোপাল নীরস গলায় বলল, “রামনামে কি আজকাল আর কাজ হয় রে? সেকালে হত। তবু করে দ্যাখ।”
পীতাম্বর আর্তনাদ করে উঠল, “ওরে সর্বনাশ! ও নাম নিসনি! নিসনি! তা হলে যে আমাকে তফাত হতে হবে।”
তা হলও তাই। গোবিন্দ কষে রামনাম শুরু করতেই যেন বাতাসের একটা ঝাঁপটায় পীতাম্বর ছিটকে বিশহাত তফাতে চলে গেল। আর ওদের কাছে এগোতেই পারল না।
মনের দুঃখে পীতাম্বর অগত্যা সাতড়ি শিকদারের প্ল্যানচেটের ঘরে ঢুকে পড়ল।
দৃশ্যটা বেশ গা-ছমছমে।
মাঝখানে একটা কাঠের টেবিলের ওপর একটা করোটি রাখা। তার পাশেই মোমদানিতে একটা মোম জ্বলছে। একধারে বিশাল ঘণ্ডা চেহারার সাতকড়ি বসে আছে, অন্যপাশে তার ভায়রাভাই নবেন্দ্র, আর তিন নম্বর হল বুড়ো হলধর পাণ্ডা। তিনজনেই ধ্যানস্থ। ভীষণ ঠাণ্ডা বলে তিনজনেই যথাসাধ্য চাপাচুপি দিয়ে বসেছে। হলধরের গলা অবধি বাঁদুরে টুপিতে ঢাকা। হলধরের মধ্যেই নাকি বোজ ভূত সেঁধোয়, প্রত্যেকদিনই হলধর নাকি সুরে নানা কথা কয়। কিন্তু পীতাম্বর জানে, ওসব ফকিকারি ব্যাপার। হলধর একসময়ে যাত্রা করত, অভিনয়টা ভালই জানে। ভরটর একদম বাজে কথা।
তবে আজকের সাফল্যে উজ্জীবিত পীতাম্বরের ইচ্ছে হল, সত্যি-সত্যিই হলধরের ঘাড়ে ভর করার। অনেকবার চেষ্টা করে পারেনি ঠিকই, কিন্তু আজ তার ইচ্ছাশক্তি বেশ চাগাড় দিয়ে উঠেছে। ইচ্ছাশক্তির বলে পীতাম্বর খুব সরু হয়ে হলধরের নাক দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ফলে হলধর দুটো হাঁচি দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে বেরিয়ে এল পীতাম্বর। কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না। সে আর নাকের দিকে না গিয়ে কানের ভেতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে ঢুকে পড়ল ভেতরে।