“কোন মুখে? রদ্দা তো মারলুম আমি, তোমার বখরার কথা তা হলে ওঠে কেন?”
“তুই কি ভাবিস রদ্দাটা আমিই মারতে পারতুম না? সময়মতো মারতুমও, তুই মাঝখান থেকে উঠে ফটাস করে মেরে দিলি। একে কী বলে জানিস? মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া।”
“তা তুমি গেজেটা পেলে কী করতে? দিতে আমাকে আধাআধি বখরা?”
চোখ কপালে তুলে গোপাল বলল, “দিতুম না? বলিস কী? এখনও ভগবান আছেন, এখনও চাঁদসুয্যি ওঠে, এখনও ধর্ম বলে একটা জিনিস আছে। সবাই জানে আমি ধর্মভীরু লোক।”
“তা হলে বলি গোপালদা, চটের হাটে সেবার তামাকের ব্যাপারির গদিতে হামলা করে ক্যাশ হাতিয়েছিলে, মনে আছে? আমাকে দিলে মোটে এগারোটা টাকা। থলিতে কত ছিল তা আমাকে বলেছিলে কখনও? নিত্যপদর মেয়ের সোনার হারখানা ছিঁড়ে নিয়ে নয়াগঞ্জে বেচেছিলে, আমাকে কত দিয়েছিলে মনে আছে? মাত্র একুশ টাকা। তখন তো আমি একটাও কথা বলিনি। হিসেবও চাইনি।”
গোপাল গলাখাকারি দিয়ে বলল, “আচ্ছা, ওই সাত টাকাই দিস। কাজিয়া করে লাভ নেই, হাতে গুরুতর কাজ।”
“তা বটে।”
হঠাৎ গোবিন্দ দাঁড়িয়ে পড়ে পিছুপানে চেয়ে বলল, “গোপালদা, কেউ আমাদের পিছু নেয়নি তো! কেমন যেন একটা মনে হচ্ছে।”
গোপাল পেছন দিকটা দেখে নিয়ে বলে, “কোথায় কে?” গোবিন্দ ফের বলল, “একটা বোঁটকা গন্ধ পাচ্ছ গোপালদা?”
“বোঁটকা গন্ধ! কই না তো!”
“আমি কিন্তু পাচ্ছি। ঘেমো জামা ছেড়ে রাখলে তা থেকে যেমন গন্ধ বেরোয় সেরকম গন্ধ।”
“এখন কি গন্ধ নিয়ে ধন্দের সময় আছে রে! কত্তাবাবু বসে আছেন, বুড়োটাকে নিয়ে গিয়ে তার সামনে ফেলতে হবে, তার পর একটু জিরোতে পারব। চল, চল।”
“উঁহু এ যেমন-তেমন গন্ধ বলে মনে হচ্ছে না গো গোপালদা। এ যে তেনাদের গন্ধ!”
“তোর মাথা।”
“আমার ঠাকুর্দা ভূত পুষত, তা জানো? তার ঘরে ঢুকলে এ রকম গন্ধ পাওয়া যেত।”
কথাটা শুনে তিন হাত পেছনে দাঁড়ানো পীতাম্বর খুশি হল।
এতদিন পর এই প্রথম একটা লোক যে তাকে টের পাচ্ছে এটা খুব ভাল খবর। পীতাম্বর যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন ছিল তার বেজায় ভূতের ভয়। দিনেদুপুরে এ-ঘর থেকে ও-ঘর যেতে পারত না একা। তারপর একদিন যখন দেহ ছাড়তে হল, তখন শরীর থেকে বেরিয়ে এসেই দ্যাখে, সামনে ধোঁয়াটে মতো কে একটা দাঁড়িয়ে, তাকে দেখে আঁতকে উঠে “ভূত! ভূত!” বলে চেঁচিয়ে পীতাম্বর মূর্ছা যায় আর কী? সনাতন তার বন্ধু মানুষ, দু’বছর আগে পটল তুলেছে। তা সনাতনই এসে তাকে ধরে তুলল, তারপর বলল, “আর লোক হাসাসনি। এতদিন পর পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা, কোথায় খুশি হবি, না মূছ যেতে বসলি? ওরে নিজের দিকে একটু চেয়ে দ্যাখ দেখি। পীতাম্বর নিজের দিকে চেয়ে যা দেখল তাতে তার ফের মূর্ছা যাওয়ায় জোগাড়। সেও ভারী ধোঁয়াটে আর আবছা এক বস্তুতে পরিণত হয়েছে। সেই থেকে তার একটা সুবিধে হয়েছে, ভূতের ভয়টা আর একদম নেই।
তবে হ্যাঁ, নিজের ভূতের ভয় গেলেও অন্যকে ভয় দেখানোর একটা দুষ্টবুদ্ধি তার মাথায় চেপেছে। সনাতন অবশ্য বলে, “দুর, দুর, ওসব করে লাভ কী? তার চেয়ে চল সাতগেছের হাটে মেছোবাজারে ঘুরে বেড়াই। আহা, সেখানকার আঁশটে পচা গন্ধে চারদিক ম ম করছে, গেলে আর আসতে ইচ্ছে যায় না।” পীতাম্বরের আজকাল ওসব গন্ধ খুবই ভাল লাগে। কিন্তু শুধু অজানা, অচেনা, অখ্যাত এক ভূত হয়ে থাকাটা তার পছন্দ নয়। নিজেকে জাহির না করলে হলটা কী? তাই সে মাঝেমাঝেই ভরসন্ধেবেলা নির্জন জায়গায় কোনও লোককে একা পেলে তার সামনে গিয়ে উদয় হয়, নাকিসুরে কথাও বলে। দুর্ভাগ্য তার, আজ অবধি কেউ তাকে দেখতে পেল না, তার কথাও শুনতে পেল না। এই তো সেদিন বামুনপাড়ার পুরুতমশাই কোথায় যেন কী একটা পুজো সেরে বটতলা দিয়ে বেশি রাতে একা ফিরছিলেন। পীতাম্বর গিয়ে তার সামনে অনেক লম্ফঝ করল, টিকি ধরে টানল, হাতে চালকলার থলি কেড়ে নিতে চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই হল না। পন্ডিতমশাই দিব্যি নির্বিকারভাবে চলে গেলেন। সব শুনে সনাতন বলল, “দৃশ্যমান ভূত হওয়া খুব শক্ত। অনেক সাধনা করলে তবে একটু-আধটু দেখা দেওয়া যায় বলে শুনেছি। তা অত কসরত করে লাভ কী? এখন ছুটি পেয়ে গেছিস, ঝুটঝামেলা নেই, মজা করে ঘুরে বেড়াবি চল। বাঁকা নদীর ধারে আজ ভুতুড়ে গানের জলসা বসছে, যাবি? ওঃ, সে যা সুন্দর গান! জগঝম্প, শিঙে, কাঁসর, বড় কত্তাল, আর তার সঙ্গে ব্যাঙের ডাক, গাধার চেঁচানি আর ঘোড়ার চিহিহি মিশিয়ে একটা ব্যাকগ্রাউণ্ড তৈরি হয় আর সবাই পুরো বেসুরে চেঁচায়। শুনলে মোহিত হয়ে যাবি।” হ্যাঁ, পীতাম্বরের সেই জলসার গান খুবই পছন্দ হল। বেঁচে থেকে এ-গান শুনলে তার দাঁতকপাটি লাগত। কিন্তু এখন যেন কান জুড়িয়ে গেল। মনে হল, হ্যাঁ, এই হল আসল গান।
তা বলে পীতাম্বর চেষ্টা ছাড়ল না। নিজের বাড়িতে গিয়ে একদিন সে নিজের বিধবা বউ আর ছেলেপুলেদের বিস্তর ভয় দেখানোর চেষ্টা করে এল। কিছুই হল না। শুধু অনেক মেহনতে বারান্দার ধারে রাখা একখানা পেতলের ঘটি গড়িয়ে উঠোনে ফেলে দিতে পেরেছিল। তাতে তার বউ কে রে?” বলে হাঁক মেরে বেরিয়ে এসে ভারী বিরক্ত হয়ে বলল, “নিশ্চয়ই ওই নচ্ছার বেড়ালটা!” বলে ঘটিটা তুলে রাখল। একে তো আর ভূত দেখাও বলে না, ভয় খাওয়াও বলে না। এ-ঘটনা শুনে কিন্তু সনাতন অবাক হয়ে বলল, “তুই ঘটিটা ফেলতে পেরেছিস! উরেব্বাস, সে তো কঠিন কাণ্ড। নাঃ, তোর ভেতরে অনেক পার্টস আছে দেখছি। তুই লেগে থাক, নিশ্চয়ই একদিন লোকে তোকে দেখতে পাবে।”