নবীন লোক দুটোকে বিশেষ পছন্দ করছিল না। সে নির্বিকার মুখে বলল, “সারাদিন কত লোক আসছে যাচ্ছে। মোটকা, শুটকো, বুড়ো, যুবো, কালো, ধলল, কে তার হিসেব রাখে! তা বুড়ো মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন কেন?”
গোবিন্দ আর গোপাল একটু মুখ-তাকাতাকি করে নিল। তারপর গোপাল বলল, “ইনি আমাদের দাদু হন। মাথার একটু গণ্ডগোল আছে। রাগ করে বেরিয়ে পড়েছেন, তাই খুঁজতে বেরিয়েছি। ভাল করে ভেবে দ্যাখো দিকি, লম্বা কোট আর বাঁদুরে টুপি পরা খুব শুটকো চেহারার একজন বুড়ো মানুষকে দেখেছ বলে মনে পড়ে কি না।”
নবীনের খুব মনে আছে। তবে সে এ দুজনকে একটু খ্যাপানোর জন্য বলল, “কত লোক আসছে যাচ্ছে, কত মনে রাখব? তবে একটু ভাবতে হবে। ভাবলে যদি মনে পড়ে!”
“তা ভাবতে কতক্ষণ লাগে তোমার?”
নবীন বলল, “আমাদের বিদ্যেবুদ্ধি তো বেশি নয়, তার ওপর পেঁয়ো মানুষ, আমাদের ভাবতে একটু বেশি সময় লাগে মশাই। এই ধরুন ঘণ্টাখানেক।”
“তো তাই সই। ততক্ষণ আমাদের দুজনকে আধসের করে চিড়ে আর একপো করে আখের গুড় দাও দিকিনি। দইটই পাওয়া যায় না এখানে?”
“পাওয়া যাবে না কেন? পয়সা দিন, মহাদেব ময়রার দোকান থেকে এনে দিচ্ছি।”
“বাঃ, তুমি তো বেশ ভাল লোক দেখছি।”
“নফরগঞ্জ ভাল লোকদেরই জায়গা।”
নবীন পয়সা নিয়ে দই এনে দিল, তাতে তার কিছু আয়ও হল। পাঁচশো গ্রামের জায়গায় পঞ্চাশ গ্রাম কম এনেছে সে। এই সূক্ষ্ম হেরফের বোঝার মতো মাথা লোকদুটোর নেই! অবস্থাও বেগতিক। সাত ক্রোশ হেঁটে এসে দুজনেই হেদিয়ে পড়েছে। নবীন একটু চড়া দামেই দুটো মেটে হাঁড়ি বেচল গোবিন্দ আর গোপালকে। দুজনে হাঁড়িতে চিড়ে মেখে গোগ্রাসে খেয়ে এক এক ঘটি করে জল গলায় ঢেলে ঢেকুর তুলল। তারপর গোবিন্দ জিজ্ঞেস করল, “মনে পড়ল নাকি হে মুদিভায়া?”
“ভাল করে ভেবে দেখছি। সেই প্রাতঃকাল থেকে যত লোক এসেছে গেছে সকলের মুখই ভাবতে হচ্ছে কিনা। এক ঘণ্টার মোটে এই আধ ঘণ্টা হল। তাড়া কীসের?”
“একটু তাড়াতাড়ি আর কষে ভাবো হে। আধ ঘণ্টা পুরতে আর কতক্ষণই বা লাগবে, বড়জোর পাঁচ সাত মিনিট।”
নবীন ফিচিক করে হেসে বলল, “তা মশাই, মাথাটা যে খাটাতে হচ্ছে তারও তো একটা মজুরি আছে না কি?”
“ও বাবা, তুমি যে ধুরন্ধর লোক!”
“যা আকাল পড়েছে। বেঁচেবর্তে থাকতে গেলে ধুরন্ধর না হয়ে উপায় আছে?”
“তা কত চাও?”
“পাঁচটা টাকা ফেললে মনে হয় মাথাটা ডবল বেগে কাজ করবে।”
“রেট বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে হে। দুটো টাকা ঠেকাচ্ছি, ওর মধ্যেই মাথাটা খাঁটিয়ে দাও ভাই।”
নবীন টাকা দুটো গেজের মধ্যে ভরে ফেলে বলল, “যেমনটি খুঁজছেন তেমন একজন এই সন্ধেবেলাতেই এসেছিলেন বটে। তিনি একজন কৃপণ লোক খুঁজছিলেন।”
এ-কথায় দু’জনেই সোজা হয়ে বসল। গোপাল বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই তো সেই লোক। তা গেল কোথায় লোকটা?”
নবীন হাত বাড়িয়ে বলল, “আরও দুটো টাকা।”
দু’জনে ফের মুখ-তাকাতাকি করে নিল। তারপর গোপাল বলল, “একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি মুদির পো?”
“দিনকালটা কী পড়েছে সেটাও বিবেচনা করুন। বিনি পয়সায় কোন কাজটা হচ্ছে?”
কথাটা ভাল করে শেষ করার আগেই গোবিন্দ নামের লোকটা চাঁদরের তলা থেকে ফস করে একটা হাতখানেক লম্বা ঝকঝকে ছোরা বের করে লাফিয়ে উঠে নবীনের গলার মাফলারটা খামচে ধরে বলল, “আমরা হলুম কত্তাবাবুর পাইক, আমাদের সঙ্গে ইয়ার্কি?”
নবীন চোখ কপালে তুলে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বলছি, বলছি। তিনি ওই সাতকড়ি শিকদারের বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। উনিই এখানকার সবচেয়ে কৃপণ লোক কিনা। সোজা গিয়ে ডানহাতি গলির শেষ বাড়ি।”
গোবিন্দ বিনা বাক্যে নবীনের গেজেটা কেড়ে নিয়ে নিজের টাকে খুঁজে বলল, “শোনো মুদির পো, তুমি অতি পাজি লোক। আর আমরাও খুব ভাল লোক নই। এর পর থেকে সমঝে চোলো।“
এই বলে গোবিন্দ হাতের কানা দিয়ে নবীনের মাথায় একখানা ঘা বসাতেই রোগাভোগা নবীন মূছ গেল। গোপাল আর গোবিন্দ মিলে ধরাধরি করে নবীনকে দোকানের ভেতরে ঢুকিয়ে তার ব্ল্যাক থেকে চাবি নিয়ে দোকান বন্ধ করে বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে দিল।
গোপাল খুশি হয়ে বলল, “বাঃ, কাজটা বেশ পরিষ্কার করে করেছিস তো?”
গোবিন্দ দুঃখের সঙ্গে বলল, “লোকে এত আহাম্মক কেন বলল তো! এই যে মুদির পোকে এক ঘা দিতে হল, এতেই ভারী পাপবোধ হচ্ছে। বোষ্টম হওয়ার পর থেকে আর লোকজনকে মারধর করতে ইচ্ছে যায় না, জানো! কিন্তু একে না মারলে ঠিক চেঁচিয়ে লোক জড়ো করত।”
“ঠিক বলেছিস। এখন চল সাতকড়ি শিকদারের খপ্পর থেকে বুড়োটাকে বের করে এনে চ্যাংদোলা করে নিয়ে কত্তাবাবুর পায়ের কাছে ফেলি।”
“চলো।”
“তা ইয়ে, গেজের মধ্যে কত আছে দেখলি না?”
“গেঁজে দিয়ে তোমার কাজ কী?”
“ভাগ দিবি না?”
“কীসের ভাগ? গেঁজে তো আমার রোজগার।”
“কাজটা কি ভাল করলি গোবিন্দ? মানছি তোর গায়ের জোর বেশি, খুনখারাপিও অনেক করেছিস। কিন্তু মনে রাখিস, বুদ্ধি পরামর্শের জন্য এই শর্মাকে ছাড়া তোর চলবে না।”
“ঠিক আছে, পাঁচটা টাকা দেব’খন।”
“মোটে পাঁচ? আর একটু ওঠ।”
“তা হলে সাত।”
“পুরোপুরি দশ-এ রফা করে ফ্যাল।”
“কেন, দশ টাকা পাওয়ার মতো কোন কাজটা করেছ তুমি শুনি! গা না ঘামিয়েই ফোকটে রোজগার করতে চাও?”
গোপাল মাথাটা ডাইনে বাঁয়ে নেড়ে বলল, “কালটা যদিও ঘোর কলি, তবু এত অধর্ম কি ভগবান সইবেন রে? মুদির গেঁজের মধ্যে না হোক পাঁচ সাতশো টাকা আছে। বখরা চাইলে আধাআধি চাইতে পারতুম।”