একটা শ্বাস ফেলে চিতেন বলল, “বুঝেছি। বিপিনবাবুকে আপনি জ্যান্ত যখ করে রেখে যেতে চান।”
“নাঃ, তুমি একেবারে গবেট নও তো! বুদ্ধি আছে।”
“তা ভজনবাবু, এই যে আপনি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এখন আপনার ধনসম্পত্তি দেখাশোনা করছে কে?”
“তার ভাল ব্যবস্থা আছে। গজানন, ফুলমণি, নরহরি সব দিনরাত চোখে চোখে রাখছে।”
“তারা কারা? আপনার ছেলেমেয়ে বুঝি?”
“ওরে বাবা, না। তারা সব অশরীরী।”
“অশরীরী মানে! ভূত নাকি?”
“মানে তো তাই দাঁড়ায়। তবে কিনা সামনেই ফাল্গুন মাস। ফাল্গনে নয়নপুরে শিবরাত্রির মেলা। সেখানে ভূতেদেরও মস্ত মেলা হয়। বছরে এই একটাই তাদের বড় পরব। তাই সবাই মাঘ মাসেই সেখানে দলে দলে গিয়ে হাজির হয়। আমার মুখ চেয়ে তারা পাহারা দিতে রাজি হয়েছে বটে, কিন্তু দেরি দেখলে সব নয়নপুরে পালাবে। ভূতেদের বিশ্বাস কী বলো!”
চিতেন বড় বড় চোখে চেয়ে বলে, “আপনার ভয়ডর নেই নাকি মশাই?”
“খুব আছে, খুব আছে। প্রথম যখন সেখানে গিয়ে হাজির হই, চারদিকে দুর্দম জঙ্গল, কয়েক ক্রোশের মধ্যে লোকালয় নেই। ভাঙা পোড়ো বাড়ির মধ্যে বিষধর সাপখোপ ঘুরে বেড়ায়, শেয়ালের বাসা, নেকড়ে বাঘের আনাগোনা তো আছেই, তার ওপর গিসগিস করছে ভূত। সে কী তাদের রক্ত-জল-করা হিঃ হিঃ হাসি, কী দুপদাপ শব্দ, কী সব ভয়ঙ্কর দৃশ্য।”
“আপনার ভয় করল না?”
“করেনি আবার! দাঁতকপাটি লেগে যাই আর কী! তবে কিনা সোনাদানা, হিরে-জহরতের মায়াও কি কম! তাই মাটি কামড়ে পড়ে ছিলাম। ওই দু-চারদিন যা ভয়টয় করেছিল। তারপর দেখলাম, ভূতকে ভয় করে লাভ নেই। বরং ভাব জমাতে পারলে লাভ। ভূতেরাও দেখল, আমাকে তাড়ানো সহজ নয়। তাই তারাও মিটমাট করে নিল। এখন বেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলছে।”
“আর সাপখোপ?”
“তাদেরও আমি ঘাটাই না, তারাও আমাকে ঘাঁটায় না। জঙ্গলেরও একটা নিয়ম আছে। তোমাদের মতো অরাজক অবস্থা নয়। যে যার নিজের এলাকায় নিজের কাজটি নিয়ে থাকে, অযথা কেউ কাউকে বিরক্ত করে না।”
“ঠিক এই সময়ে কাশীবাসীমাসি এক কাপ গরম চা আর পিরিচে দুখানি বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকতেই ভজনবাবু একগাল হেসে বলে উঠলেন, “এসো খুকি, এসো। তা নামটি কী তোমার?”
কাশীবাসীমাসি ভয়-খাওয়া ফ্যাঁসফ্যাসে গলায় বললেন, “আজ্ঞে, আমি কাশীবাসী। আপনি মহাজন মানুষ, গরিবের বাড়িতে একটু কষ্ট হবে। বিপিন বাজার থেকে এসেই আপনার জন্য ময়দা মাখতে বসেছে। এল বলে?”
“আহা, তার আসার দরকার কী? মাখুক না ময়দা। ময়দার ধর্ম হল যত মাখা যায় ততই লচি মোলায়েম হয়। কী বলো হে?”
চিতেন মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে, অতি খাঁটি কথা। তা ভজনবাবু, এই সাঙ্ঘাতিক জায়গাটা ঠিক কোথায় বলুন তো! কাছেপিঠেই কি? না কি একটু দূরেই?”
ভজনবাবু চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে খেতে একটা আরামের শ্বাস ফেলে বললেন, “কাছে না দূরে, পুবে না পশ্চিমে সেসব বলে কি নিজের আখের খোয়াব হে? আমাকে অত আহাম্মক পাওনি।”
“আজ্ঞে তা তো বটেই। সবাইকে বলে বেড়ালে আর গুপ্তধনের মানমর্যাদা বলেও কিছু থাকে না কিনা। মোহর তা হলে ওই সাত ঘড়া-ই তো! না কি দু-চার ঘড়া এদিক-সেদিক হতে পারে?”
“পাক্কা সাত ঘড়া। গত ষাট বছর ধরে রোজ গুনে দেখছি, কম-বেশি হবে কী করে?”
“আর ইয়ে ভজনবাবু, হিরে-মুক্তো কতটা হবে?”
“তা ধরো আরও সাত ঘড়া।”
“আপনি প্রাতঃস্মরণীয় নমস্য মানুষ। একটু পা টিপে দেব কি ভজনবাবু?”
“খবরদার না।”
“আচ্ছা, আপনার তো একজন কাজের লোকও দরকার, নয় কি? বয়স হয়েছে, জঙ্গলে একা থাকেন।”
“একাই দিব্যি আছি।”
৩. রাত ন’টা নাগাদ নবীন মুদি
রাত ন’টা নাগাদ নবীন মুদি যখন দোকান বন্ধ করার জন্য তোড়জোড় করছে, তখন দুটো লোক এসে হাজির। দু’জনেরই মুশকো চেহারা। একজন আর-একজনকে বলছিল, “তোর জন্যই সুযোগটা ফসকাল। বললুম অতটা পাঁঠার মাংস খাওয়ার পর একবাটি পায়েস আর গিলে কাজ নেই। শুনলি সেই কথা! পেট খারাপ করে ফেললি বলেই তো লোকটা হাওয়া হয়ে গেল। এমন সুযোগ আর আসবে?”
দ্বিতীয় লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “আমার ঠাকুর্দা কী বলতেন জানো গোপালদা, তিনি বলতেন, ওরে গোবিন্দ, পাত পুঁছে খাবি, খাবার জিনিস ফেললে অভিশাপ লাগে। আজ যা ফেলবি কাল তারই আর নাগাল পাবি না। ধর বেগুনভাজাটা ফেলে উঠলি, তো একদিন দেখবি তোর পাতে আর কেউ বেগুনভাজা দিচ্ছে না, মাছ ফেলবি তো পাতের মাছ একদিন লাফিয়ে পালাবে। সেই শুনে ইস্তক আমি খুব হুঁশিয়ার হয়ে গেছি। মরিবাঁচি পাতে কিছু ফেলে উঠি না।”
“আহা, কী মধুর বাক্যই শোনালেন। বলি, খাওয়াটা আগে না কাজটা আগে? এই তোকে বলে রাখছি গোবিন্দ, ওই লোভই তোকে খাবে। এ পর্যন্ত তোর পেটের রোগের জন্য কটা কাজ পণ্ড হল সে হিসেব আছে?”
“এবারের মতো মাপ করে দাও দাদা। হেঁটে হেঁটে হেদিয়ে গেছি, খিদেও লেগেছে বড় জোর।”
“এর পরেও খেতে চাস? তোর কি আক্কেল নেই?”
গোপাল অভিমানভরে বলল, “আমার খাওয়াটাই দেখলে গোবিন্দদা, আর এই যে সাত ক্রোশ হাঁটলুম এটার হিসেব করলে না? পেটের নাড়িভুড়ি অবধি খিদের চোটে পাক খাচ্ছে।”
দুজনে সামনের বেঞ্চে বসে পিরানের নীচে কোমরে বাঁধা গামছা খুলে মুখটুখ মুছল। তারপর গোপাল নবীনের দিকে চেয়ে বলল, “ওহে মুদি, সঁটকো চেহারার একজন বুড়ো মানুষকে এদিকপানে আসতে দেখেছ?”