ভজনবাবু খ্যাঁক করে উঠে বললেন, “কেন, আমি কি পিচেশ না সাহেব যে, জুতো পরে বিছানায় শোব?”
একগাল হেসে চিতেন বলল, “যাক বাবা, বাঁচা গেল। এমন ঢাকাঁচাপা দিয়ে রেখেছেন নিজেকে যে, চেনার উপায়টি পর্যন্ত নেই। তা বলছিলুম ভজনবাবু, ওদিকে তো মাসিরা ময়দা-টয়দা মেখে ফেলেছে, ছোলার ডাল সেদ্ধ হয়ে এল বলে, তা এই সময়টায় জুতা-মোজা খুলে একটু হাত-মুখ ধুয়ে নিলে হয় না? টুপিটা খুলতে না চান খুলবেন না, কিন্তু যদি অনুমতি করেন তো পায়ের কাছটিতে বসে জুতোজোড়া খুলে দিই। বেশ জাম্বুবান জুতো আপনার, ফিতের ঘর বোধ হয় দশ বারোটা।”
ভজনবাবু একটু দোনোমোনো করে বললেন, “তা খুলতে পারো।”
মহানন্দে চিতেন ভজনবাবুর পায়ের কাছটিতে বসে জুতো খুলতে লেগে গেল। ভজনবাবুর লম্বা ঝুলের কোটটা হাঁটুর নীচে প্রায় গোড়ালি অবধি নেমেছে। ডান দিকের পকেটটা চিতেনের একেবারে হাতের নাগালে। এই পকেটেই মোহর আর হিরেখানা রয়েছে। ডান পায়ের জুতো খুলতে খুলতেই দু আঙুলের ফাঁকে ধরা আধখানা ব্লেড দিয়ে পকেটের কাপড়টা ফাঁক করে ফেলল চিতেন। টুকুস করে মোহর আর হিরেখানা তার মুঠোয় এসে যাওয়ার কথা। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয়, পকেট থেকে কিছুই পড়ল না। তবে কি বাঁ পকেট? নাঃ, এতটা ভুল চিতেনের চোখ করবে না। জানলার ফাঁক দিয়ে সে সবই লক্ষ করেছে। তবে যদি হুঁশিয়ার বুড়ো পকেট বদল করে থাকে তো অন্য কথা। চিতেন বাঁ পায়ের জুতো খোলার সময় বাঁ পকেটটাও কেটে ফেলল, কিছুই বেরোল না।
ফোকলা মুখে একটু হেসে ভজনবাবু বললেন, “কী, পেলে না তো! ওরে বাবা, তোমার মতো কাঁচা চোর যদি আমাকে বোকা বানাতে পারত, তা হলে আর এই শর্মার নাম রামভজন আদিত্য হত না, বুঝলে? পকেটদুটো খামোখা ফুটো করলে, এখন ফের সেলাই করে কে?”
চিতেন একটু বোকা বনে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ভজনবাবুর পা ছুঁয়ে একটা প্রণাম করে বলল, “আপনি ওস্তাদ লোক।”
ভজনবাবু দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন, “আনাড়িতে যে দেশটা ভরে গেল রে বাপ! যেমন কাঁচা মাথা, তেমনই কাঁচা হাত। ছ্যাঃ ছ্যাঃ, এইসব দেখতেই কি এতদিন বেঁছে আছি! এর চেয়ে যে মরে যাওয়া অনেক ভাল ছিল।”
চিতেন লজ্জায় কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থেকে খুব অভিমানের সঙ্গে বলল, “তা আমাদের শেখায় কে বলুন! নফরগঞ্জের মতো পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছি, ভাল কোচ পাব কোথায়? ঠিকমতো কোচিং পেলে কি আর খেল দেখাতে পারতুম না! তা ভাগ্যে যখন আপনাকে পেয়ে গেছি তখন আর ছাড়ছি না, দু-চারটে কায়দা শিখিয়ে দিন ভজনবাবু।”
ভজনবাবু ফের খ্যাক করে উঠলেন, “আমি শেখাব? কেন, আমি কি চোর না ছ্যাচড়া? তুমি তো আচ্ছা বেয়াদব হে! ওসব আমার কর্ম নয়। যারা শেখায় তাদের কাছে যাও।”
কাঁচুমাচু হয়ে চিতেন বলল, “আপনার বুঝি এসব আসে না?”
“পাগল নাকি? জীবনে পরদ্রব্য ছুঁইনি। তবে হ্যাঁ, শিখতেই যদি চাও তবে কুঁড়োরহাটের সামন্তকে গিয়ে ধরো। এই অষ্টাশি বছর বয়স হল, তবু বিদ্যে ভোলেনি। ভাল চেলা পেলে শেখায়। পাঁচশো টাকা নজরানা আর সেইসঙ্গে ভালরকম ভেট দিতে ভুলো না। ভেট মানে জ্যান্ত একটা পাঁটা, আস্ত একখানা রুই মাছ, মিহি পোলাওয়ের চাল, গাওয়া ঘি আর তরিতরকারি এইসব আর কী।”
চিতেন লজ্জিতভাবে মাথা চুলকে বলল, “তাই যেতাম ভজনবাবু। কিন্তু ভাবছি কুঁড়োরহাটে সামন্তর কাছে গিয়ে এত বিদ্যে শিখে হবেটাই বা কী? আমাদের কাজ তো এই নফরগঞ্জের মতো অজ পাড়াগাঁয়ে। গেরস্তবাড়িতে ঢুকে পাওয়া যায় তো লবডঙ্কা। বড়জোর কাঁসার বাসন, মোটা ধুতি, মোটা শাড়ি, খুব বেশি হলে ফিনফিনে সোনার একটা চেন বা মাকড়িটাকড়ি। পাইলট হয়ে এসে কি শেষে গোরুর গাড়ি চালাব মশাই?”
ভজনবাবু ফোকলা মুখে একগাল হেসে বললেন, “তা বটে। ভাল চোরেরও আজকাল পেট ভরে না। দেশে খুবই অরাজক অবস্থা।”
“তা ইয়ে, বলছিলুম কি ভজনবাবু, একটা কথা ছিল।”
“কী কথা হে?”
“আমি আড়ি পেতে আপনার আর বিপিনদাদার কথাবাতা সবই শুনেছি। তা মশাই, আপনি কৃপণ লোক কেন খুঁজছেন সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
“বুঝতে মাথা চাই, বুঝলে? কৃপণ লোক কেন খুঁজছি এটা বুঝতে পারা শক্তটা কী? কৃপণের কাছে কিছু থাকলে সে সেটা বুক দিয়ে আগলে রাখবে, মরে গেলেও খরচ করবে না। তাই কৃপণ হল ব্যাঙ্ক। এক তাল সোনা তাকে দিয়ে তীর্থভ্রমণে চলে যাও। তিন মাস পরে এসে দেখবে এক তাল সোনাই রয়েছে, এক রতিও খরচ হয়নি।”
“সেটা ঠিকই। তবে কৃপণ নিজের জিনিসই আগলায়, অন্যের গচ্ছিত রাখা জিনিসও কি আগলাবে ভাবেন?”
“দুর বোকা, অন্যের জিনিস বলে ভাবতে দেবে কেন? তাকে এক তাল সোনা দিয়ে বলল, এটা তোমাকে দিলুম।”
“তারপর?”
“তারপর এসে একদিন তাপ্পি মেরে হাতিয়ে নিলেই হল।”
চিতেন চোখ বড় বড় করে বলল, “আপনি যে সাঙ্ঘাতিক লোক মশাই।”
“সাঙ্ঘাতিক কি না জানি না, তবে গবেট নই।”
“তা হলে ভজনবাবু, আপনি সত্যি-সত্যিই ওইসব সোনাদানা আর হিরে-জহরত বিপিনবাবুকে দিচ্ছেন না।”
ভজনবাবু ফের ফোকলা মুখে হেসে বললেন, “তাই কি বলেছি? ওরে বাবা, আমারও তো বয়স হল, না কি! এই একশো পেরিয়ে দেড় কুড়ি। তোমাদের হিসেবে একশোত্রিশ বছর। দু-চার বছর এদিক-সেদিক হতে পারে, কিন্তু কবে পটল তুলি তার ঠিক কী? তা আমি পটল তুললে তোমার ওই বিপিনবাবুই সব পাবে।”