হাসিমাসি বললেন, “তা কী করব বাবা বল, বিপনে যে দশ ফোঁটার বেশি পনেরো ফোঁটা তেল তরকারিতে দিলে ‘ওরে বাবা, এ যে তেলের সমুদুর বলে রাগ করে খাওয়া ফেলে উঠে যায়।”
চিতেন বলল, “মাসিমাগণ, এক-একজনের এক একরকম সুখ! কৃপণের সুখ কৃচ্ছসাধনে। বিপিনবাবু দুঃখ পেতে ভালবাসেন বলেই দুঃখ জোগাড় করে আনেন। তাঁর জন্য আপনাদের দুঃখ হয় জানি, কিন্তু তার ওপর আপনারা যে দুঃখ পাচ্ছেন তাতে দুঃখ যে ডবল হয়ে যাচ্ছে।”
“তা কী করব বাবা, একটা বুদ্ধি দে।”
“আমি বলি কী, বিপিনবাবু যখন দুঃখের মধ্যেই সুখ পাচ্ছেন তখন আপনাদের আর দুঃখ বাড়িয়ে কাজ নেই। দিন, টাকা দিন, আমি চুপিচুপি ভাল-মন্দ কিনে এনে রোজ দিয়ে যাব।”
“সে কি আমাদের গলা দিয়ে নামবে বাবা?”
“ভাল করে তেল-ঘি দিয়ে রান্না করবেন, দেখবেন হড়হড় করে নেমে যাচ্ছে।”
তা সেই থেকে চিনে গোপনে মাসিদের বাজার করে দিয়ে যায় বোজ। সেরা তরকারি, ভাল মাছ, তেল, ঘি। দুধওলাও ঠিক করে দিয়েছে সে। মাসিরা এখন ভাল-মন্দ খেয়ে বাঁচছেন।
কাজেই এ-বাড়িতে চিতেনের বিলক্ষণ যাতায়াত।
ওদিকে বিপিনবাবু ভেতরবাড়িতে এসে শশব্যস্তে হাসিরাশিমাসিকে ডেকে বললেন, “ও মাসি, একজন মস্ত বড় মানুষ এসেছেন আজ। তাঁর জন্য লুচি, আলুর দম, ছোলার ডাল, বেগুনভাজা আর ঘন দুধ চাই। তার আগে চা-বিস্কুট। শিগগির থলিটলি দাও, আমি চট করে গিয়ে সব নিয়ে আসি।”
শুনে তিন মাসিরই মুছা যাওয়ার জোগাড়। হাসিমাসি উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন, “কে এসেছে বললি? সাধুটাধু নাকি? শেষে কি হিমালয়-টয়ে নিয়ে যাবে তোকে? ওষুধ করেনি তো!”
“আহাঃ, সেসব নয়। ইনি মস্ত মানুষ। এঁকে খুশি করতে পারলে মস্ত দাঁও মারা যাবে।”
বিপিনবাবু থলিটলি নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে যেতেই খুশিমাসি গিয়ে বিপিনবাবুর ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে এসে বললেন, “হ্যারিকেনের আলোয় যা দেখলাম তাতে মনে হল শুটকো মতো এক বুড়োমানুষ। বাঁদুরে টুপি থাকায় মুখটা ভাল দেখা গেল না। তা সে যেই হোক, তার কল্যাণে বিপিনটার পেটেও যদি আজ একটু ভাল-মন্দ যায়!”
উঠোনের দরজা দিয়ে চিতেন ঢুকে পড়ল। বারান্দায় বসা তিন চিন্তিত মাসির দিকে চেয়ে হাতজোড় করে বলল, “মাসিমাগণ, আপনাদের বাড়িতে কে একজন মহাজন না মহাপুরুষ এসেছেন বলে শুনলাম। সত্যি নাকি?”
মাসিদের সঙ্গে চিতেনের সম্পর্ক খুবই ভাল। চিতেন যে একজন উদীয়মান নবীন চোর, তাও মাসিদের অজানা নেই। এমনকী কোন বাড়িতে নতুন বউ এসেছে, কোন বাড়িতে কোন গিন্নি নতুন গয়না কিনল, সেসব সুলুকসন্ধানও মাসিরা চিতেনকে নিয়মিত দিয়ে থাকেন। মাসিদের দৃঢ় বিশ্বাস, চিতেনের যা বুদ্ধি আর এলেম তাতে সে একদিন দেশ-দশের একজন হয়ে উঠবে।
তাই তাকে দেখে তিন মাসিই হাঁফ ছেড়ে ফোলামুখে হেসে বললেন, “আয় বাবা, আয়।”
কাশীবাসীমাসি বললেন, “মহাপুরুষ কি না কে জানে বাবা, তবে বশীকরণ-টরন জানা লোক কেউ এসেছে। ভয়ে আমরা ও-ঘরে যেতে পারছি না।”
চিতেন বুক চিতিয়ে বলল, “মাসিগণ, ঘাবড়াবেন না, আমি গিয়ে বাজিয়ে দেখে আসছি।”
ভজনবাবুর বয়স একশো থেকে দেড়শো বছরের মধ্যেই হবে বলে অনুমান করল চিতেন। দুশো বছর হলেও দোষ নেই। কারণ একটা বয়সের পর মানুষের চেহারা এমন দড়কচা মেরে যায় যে, আর বুড়োটে মারতে পারে না।
তা এই বয়সের মানুষরা সুযোগ পেলেই একটু ঝিমোয় বা ঘুমোয়। কিন্তু ভজনবাবুর ওসব নেই। চিতেন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল, ভজনবাবু তার দিকে জুলজুল করে চেয়ে আছেন।
“তুমি আবার কে হে?”
চিতেন হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে, আমাকে এ বাড়ির কাজের লোক বলে ধরতে পারেন।”
লোকটা চমকে উঠে বললেন, “কী সর্বনাশ! কৃপণের বাড়িতে কাজের লোক! কাজের লোকই যদি রাখবে তা হলে আর তাকে কৃপণ বলা যাবে কী করে? অ্যাাঁ, এ তো সাঙ্ঘাতিক কথা! তা কত বেতন পাও শুনি?
চিতেন তাড়াতাড়ি জিভ কেটে বলে, “আজ্ঞে, আমি তেমন কাজের লোক নই। বিপিনবাবু নিকষ্যি কৃপণ। কৃপণকুলতিলক বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। আমি কাজের লোক হলেও বিনিমাইনে আর আপখোরাকি কাজের লোক। বিপিনবাবুর তিন মাসি আছেন, তাঁরা আমাকে একটু-আধটু স্নেহ করেন আর কী!”
“অ! তা কী মনে করে আগমন?”
“আজ্ঞে। মাসিরা জানতে পাঠালেন, আপনার কোনও সেবার দরকার আছে কি না।”
“সেবা! কীরকম সেবা?”
“এই ধরুন, একটু গা-হাত-পা টিপে দেওয়া বা মাথায় বিলি কাটা বা আঙুল মটকানো!”
ভজনবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “ও বাবা, ওসব করলে এই বুড়ো শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যাবে।”
“তা হলে অন্তত জুতো মোজা খুলে দিই, বাঁদুরে টুপিটাও খুলে ফেলে বেশ জুত করে বসুন।”
ভজনবাবু আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন, “না, না, এই বেশ আছি।”
“তা রাত্রিবেলা তো এখানেই দেহরক্ষা করবেন, না কি?”
ভজনবাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “দেহরক্ষা! দেহরক্ষা করব মানে! মশকরা করছ নাকি হে!”
জিভ কেটে হাতজোড় করে চিতেন বলে, “আজ্ঞে মুখসুখ মানুষ কী বলতে কী বলে ফেলি। বলছিলাম, রাতে তো এখানেই ঘাঁটি গাড়তে হবে, না কি!”
ভজনবাবু চিড়বিড়িয়ে উঠে বললেন, “তুমি তো আচ্ছা বেয়াদব লোক দেখছি হে! এখানে ঘাঁটি গাড়ব না তো কি এই শীতের মধ্যে মাঝরাতে বুড়োটাকে বাইরে বের করে দেবে নাকি?”
জিভ কেটে এবং নিজের কান মলে চিতেন ভারী অনুতপ্ত গলায় বলে, “কী যে বলেন ভজনবাবু, শুনলেও পাপ হয়। এই বাড়িঘর আপনার নিজের বলেই মনে করুন। বলছিলুম কী, ভজনবাবু, আপনার কি জুতোমোজা পরেই শোয়ার অভ্যেস?”