“তা তুমিই বা মন্দ কী?”
“যে আজ্ঞে, তা হলে চায়ের কথাটা মাসিকে বলে আসি।”
“সঙ্গে দুটো বিস্কুট।”
“বিস্কুট!” বলে থমকে দাঁড়াল বিপিনবাবু।
ভজনবাবু ফোকলা হেসে বললেন, “বিস্কুট শুনে মূর্ছা যাওয়ার কিছু নেই। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট আমি পছন্দ করি।”
“যে আজ্ঞে, তা হলে আর কথা কী? বিস্কুট তো বিস্কুটই সই।”
“হ্যাঁ, আর ওইসঙ্গে রাতের খাওয়াটার কথাও বলে এসো। রাতে আমি মাছ-মাংস খাই না। লুচি, আলুর দম, ছোলার ডাল, বেগুনভাজা আর ঘন দুধ হলেই চলবে।”
বিপিনবাবু চোখ কপালে তুলে মূর্ছা যাচ্ছিলেন আর কী! নিতান্তই মনের জোরে খাড়া থেকে ভাঙা গলায় বললেন, “ঠিক শুনছি তো! না কি ভুলই শুনলাম।”
“ঠিকই শুনেছ।”
“ওরে বাবা! বুকটা যে ধড়ফড় করছে। হার্টফেল হয়ে মরে না যাই।”
ভজনবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “তোমার হার্টফেল হলে বিদ্যাধরপুরের পাঁচুগোপাল আছে। তাকে আমার সবদিক দিয়েই পছন্দ ছিল। তোমাকে বাজিয়ে দেখে মনে হয়েছিল, তুমি তার চেয়েও সরেস। কিন্তু বুকের পাটা বলতে তোমার কিছু নেই।”
বিপিনবাবু সঙ্গে-সঙ্গে বুক চিতিয়ে বললেন, “কে বলল নেই! লুচি, আলুরদম, ছোলার ডাল, বেগুনভাজা আর ঘন দুধ তো! ওই সঙ্গে আমি আরও দুটো আইটেম যোগ করে দিচ্ছি, পাতিলেবু আর কাঁচালঙ্কা।”
“বাঃ বাঃ, এই তো চাই।”
“আমার হাসিরাশিমাসি রাঁধেও বড় ভাল।“
“আহা, বেশ, বেশ। আর শোনো, বিছানায় নতুন চাঁদর পেতে দেবে, একখানা ভাল লেপ। আমি আজেবাজে বিছানায় ঘুমোতে পারি না।”
২. নফরগঞ্জের উঠতি এবং নবীন চোর
নফরগঞ্জের উঠতি এবং নবীন চোর চিতেনের এই সবে নামডাক হতে শুরু করেছে। আশপাশের পাঁচ-দশটা গাঁয়ে চোরের মহল্লায় সবাই মোটামুটি স্বীকার করছে যে, চিতেন যথেষ্ট প্রতিভাবান এবং তার ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। চিতেন ছিপছিপে, ছোটখাটো, গায়ের রংটি শ্যামলা। চোরেদের বেশি লম্বা হলে বিপদ, তারা চট করে ঝোপেঝাড়ে বা টেবিল বা চৌকির নীচে লুকোতে পারে না। ঢ্যাঙা হলে দূর থেকে চোখেও পড়ে যায়। বেঁটে হওয়াটাও কাজের কথা নয়। বেঁটে হলে অনেক জিনিসের নাগাল পাবে না, উঁচু দেওয়াল টপকাতে সমস্যা হবে এবং লম্বা পা ফেলে দৌড়তে পারবে না বলে ধরা পড়ার সম্ভাবনাও বেশি। চিতেনের উচ্চতা একেবারে আদর্শ। বেঁটে নয়, লম্বাও নয়। রং কালো বলে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিতে সুবিধে। সে দৌড়য় হরিণের মতো। গায়ে জোর বলও যথেষ্ট। কিন্তু তার আসল প্রতিভা হল চোখে। চিতেনের চোখ সর্বদাই সবকিছুকে লক্ষ করে। সন্দেহজনক কিছু ঘটলেই তার চোখে পড়ে যায়।
রামভজনবাবু যখন সাঁঝবেলাটিতে নফরগঞ্জের হাটখোলার কাছে নবীন মুদির দোকানের সামনে এসে গাঁয়ে কোনও কৃপণ লোক আছে কি না তার খোঁজ করছিলেন, তখনই চিতেন তাঁকে লক্ষ করল। বুড়োমানুষটির হাবেভাবে সন্দেহ করার মতো অনেক কিছু আছে। নবীনের দোকানের সামনে বসে কাঠকয়লার আংড়ায় আগুন পোয়াচ্ছিল গাঁয়ের মাতব্বররা। বিশুবাবু একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কৃপণ! তা মশাই, কৃপণের খোঁজ করছেন কেন?”
রামভজন ফোকলামুখে হেসে বললেন, “কুঁড়োরহাটের মহাজন বিষ্ণুপদ দাসের নাম শুনেছেন কি? আমি তাঁরই কর্মচারী। তা তাঁর শখ হয়েছে মহল্লার সব কৃপণদের নিয়ে একটা সম্মেলন করবেন। সেরা কঞ্জুষকে ‘কঞ্জুষরত্ন’ উপাধি দেওয়া হবে। আমার ওপর হুকুম হয়েছে কৃপণ খুঁজে বের করতে। বড়লোকের শখ আর কী!”
এ-কথায় সবাই হইহই করে উঠল। ব্যোমকেশবাবু বললেন, “তার আর চিন্তা কী? ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছেন। ওই আমাদের বিপনেকে নিয়ে যান, তার মতো কিপ্টে ভূভারতে নেই।“
তারপর সবাই মিলে বিপিনবাবুর কিপ্টেমির মেলা গল্প বলে যেতে লাগল। কিন্তু রামভজনবাবুর আষাঢ়ে গল্পটা চিতেনের মোটেই বিশ্বাস হল না। উচ্চবাচ্য করে সে ঘাপটি মেরে একধারে বসে রইল। রামভজনবাবু যখন বিপিনের বাড়ি রওনা হলেন তখন সেও পিছু নিল। জানলায় কান পেতে সে সব কথাবার্তাও শুনল। ধনরত্নের কথাটা তার মোটেই বিশ্বাস হল না, তবে ব্যাপারটা আসলে কী, সেটা না জেনেই চলবে কী করে চিতেনের!
বিপিনের তিন মাসির কারও মনেই যে সুখ নেই তা চিতেন জানে। কাশীবাসীমাসির বয়স এই অষ্টাশি পেরিয়েছে, হাসিরাশিমাসি ছিয়াশি, আর হাসিখুশিমাসির এই আশি হল। তাঁরা কেউ বিয়ে করেননি, তিনজনে মিলে বোনো বিপিনকে অনেক আশায় মানুষ করেছেন। বিপিন তাঁদের নয়নের মণি। তাঁদের বিষয়সম্পত্তি সবই বিপিনবাবুই পাবেন। এই বাড়িঘর, গয়নাগাটি, নগদ টাকা, সব। কিন্তু হলে কী হয়, বিপিনবাবু বড় হয়ে অ্যায়সা কেপ্পন হয়েছেন যে, মাসিদের ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। হোমিওপ্যাথির শিশিতে করে রোজ এক শিশি সর্ষের তেল আনেন বিপিন। নিয়ম করে দিয়েছেন, তরকারিতে দশ ফোঁটার বেশি তেল দেওয়া চলবে না। তা সেই অখাদ্য তরকারি মাসিরা গিলবেন কী করে? বিপিন ওই অখাদ্যই সোনা-হেন-মুখ করে খান দেখে তিন মাসিই বিরলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
একদিন দুপুরবেলা চিতেন নারকোল পেড়ে দিতে এসে দেখল, তিন বুড়ি বোন চোখের জল ফেলতে-ফেলতে তেঁতুল দিয়ে কোনওরকমে ভাত গিলছেন। কাণ্ড দেখে চিতেন হাতজোড় করে বলল, “মাসিমাগণ, বিপিনবাবু কৃপণ লোক জানি, কিন্তু তা বলে আপনারা কেন কষ্ট করবেন?”