গোবিন্দ বলল, “যে আজ্ঞে।”
সোনার পেল্লায় ওজন। ঘড়া তুলে ওপরে এনে ফেলতে দু’জনেই গলদঘর্ম হয়ে গেল। কলসিরও ওজন বড় কম নয়। তোলার পর দুজনেই হাঃ হাঃ করে হাঁফাতে লাগল।
গোপাল বলল, “একটু জিরিয়ে নিই। তারপর রওনা হওয়া যাবে, কী বলিস! পরে এসে বাকি ঘড়াগুলো একে একে নিয়ে যাব।”
গোবিন্দ কথাটার জবাব দিল না। সরু চোখে সে ঘড়ার দিকে চেয়েছিল। হঠাৎ বলল, “এ কী?”
গোপালও দেখল। বলল, “অ্যাাঁ! এ তো সিসে!”
“হিরেমুক্তোই বা কোথায়? এ তো পাথরকুচি দেখছি!” দু’জনেই হাঁ করে চেয়ে ছিল। নিঃশব্দে চিতেন এসে সামনে দাঁড়াল, গম্ভীর গলায় বলল, “যাও বাপু, যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে এসো। নইলে বিপদে পড়বে।”
হাঁ করে চিতেনের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে গোবিন্দ বলল, “কী ব্যাপারটা, বলো তো?”
মাথা নেড়ে চিতেন বলল, “আমিও জানি না। তবে এটা বুঝতে পারছি, এ খুব সোজা জায়গা নয়।”
পীতাম্বর গোবিন্দর কানে-কানে বলল, “ও যা বলছে তাই করো বাপু। খামোখা বিপদ ডেকে এনো না। এখানকার কারবারটা আমিও বুঝতে পারছি না।”
গোপাল আর গোবিন্দ কেমন যেন ক্যাবলার মতো কিছুক্ষণ বসে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠল। ঘড়া আর কলসি বয়ে নীচে নিয়ে গিয়ে জায়গামতো রেখে দিল।
বিপিনবাবু উঠে বসে মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে “উঃ, আঃ” করছিলেন। চিতেন গিয়ে তাঁকে ধরে তুলে বলল, “বাড়ি চলুন বিপিনদাদা, অনেক হয়েছে।”
“কিন্তু মোহর! হিরে মুক্তো!”
চিতেন হাসল, “কোথায় মোহর! ও তো চোখের ভুল ছাড়া কিছু নয়। এই ঘরের বাইরে নিলেই মোহর যে সিসে।”
“তা হলে?”
“ওপরে চলুন বিপিনদাদা। ভজনবাবু চলে যাচ্ছেন, তাঁকে বিদায় জানাতে হবে।”
“ভজনবাবু কোথায় যাচ্ছেন?”
“যেখান থেকে এসেছিলেন, আকাশে।“
চিতেনই সবাইকে নিয়ে এসে সেই কিত প্রকাণ্ড লম্বা গাছটার কাছাকাছি দাঁড়াল। সবাই হাঁ করে দেখল, জঙ্গল ভেদ করে প্রথমে এল তিনটে ডাইনি বুড়ি। তারপর দাড়িওলা খরগোশ, হনুমান, অদ্ভুত টিয়াপাখি। সেই বিশাল গাছটার গোড়ার কাছে। হঠাৎ একটা দরজা ধীরে-ধীরে খুলে গেল। ডাইনি বুড়ির পিছু পিছু অদ্ভুত জীবজন্তুরা ভিতরে ঢুকে গেল।
তারপর একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে ভজনবাবু বেরিয়ে এলেন। একই পোশাক, বাঁদুরে টুপিতে মুখোনা ঢাকা। তাদের দিকে চেয়ে ভজনবাবু একটু করুণ হাসলেন। তারপর ধীরে ধীরে ঢুকে গেলেন ভিতরে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
হঠাৎ চারদিকে গাছপালায় একটা আলোড়ন তুলে গোঁ-গোঁ আওয়াজ উঠল। সবাই অবাক হয়ে দেখল, লম্বা গাছটা মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে। প্রথমে ধীরে, তারপর হঠাৎ তীরের মতো ছিটকে লহমায় আকাশের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
বিপিনবাবু কাঁপা গলায় বললেন, “ভজনবাবু আসলে কে রে চিতেন?”
“কে জানে! তবে মনে হয়, তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মধ্যে ইনিও একজন কেউ হবেন। চলুন, ভজনবাবুকে এখানেই মাটিতে মাথা ঠুকে একটা পেন্নাম করি।”
সঙ্গে-সঙ্গে ধড়াস ধড়াস করে সবাই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল।
গোপাল চোখের জল মুছে বলল, “গোবিন্দ, আর নয় রে, আর গণ্ডগোলের জীবনে যাব না।”
“যা বলেছ গোপালদা।”
বিপিনবাবু চোখের জল মুছে বললেন, “এবার থেকে রোজ গাওয়া ঘিয়ের লুচি খাব রে চিতেন।”
“হ্যাঁ। আর আমাকেও চুরি ছেড়ে অন্য লাইন ধরতে হবে।”
.
হ্যাঁ, যে-কথাটা বলা হয়নি তা হল, মধুবনির জঙ্গলে সেই সাত ঘড়া মোহর আর সাত কলসি মণিমানিক কিন্তু আজও পড়ে আছে। কিন্তু সে-কথা আর কেউ ভুলেও উচ্চারণ করে না।