পেছন থেকে কে যেন আস্তে করে বলল, “আছেই তো।”
চিতেন সাধারণ ছিচকে চোর হলে চমকাত বা শিউরে উঠত। কিন্তু অতি উঁচুদরের শিল্পী বলে সে স্থির রইল এবং সি-হাসি মুখ করে পেছনে তাকাল।
যে-দৃশ্যটা চিতেনের চোখে পড়ল তা দেখে অন্য লোক মূর্ছা যেত। কিন্তু চিতেন অন্য ধাতুতে গড়া বলেই গেল না। পেছনে একটা ছোট গাছের ডালে অনেকটা টিয়াপাখির মতোই একটা পাখি বসে আছে। তবে আকারে অনেক বড়। আর খুবই আশ্চর্যের কথা যে, টিয়াপাখিটার ঠোঁটের নীচে অন্তত ইঞ্চিছয়েক ঘন কালো দাডি এবং মাথায় কালো চুল আছে।
চিতেন একটু গলাখাঁকারি দিয়ে খুব বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “কথাটা কে বলল?”
টিয়াপাখিটা গাছ থেকে একটা ফল ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে কপ করে গিলে ফেলে বলল, “আমিই বললাম, কেন কোনও দোষ হয়েছে?”
টিয়াপাখি এত স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে তা জানা ছিল না। চিতেনের।
পাখিটা তার দিকে চেয়ে বলল, “আমি যে টিয়াপাখি তা কে বলল তোমাকে?”
চিতেনকে ফের উত্তেজনা কমাতে গলাখাঁকারি দিতে হল। সে বলল, “আপনি তবে কী পাখি?”
“সে তোমার বুঝে কাজ নেই। তোমার মতলব তো জানি। গুপ্তধন খুঁজতে এসেছ তো! যাও, পাবে। অনেক আছে।”
চিতেন একটু থতমত খেয়ে বলল, “আপনি কি অন্তর্যামী?” পাখিটা হিহি করে হেসে পটাং করে উড়ে গেল।
শক্ত ধাতুর চিতেনের মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছিল। স্বপ্ন দেখছে নাকি?
কে যেন মাথার ওপর থেকে বলল, “না, স্বপ্ন হবে কেন? ঠিকই দেখেছ।”
চিতেন ধীরে মুখটা ওপরে তুলে দেখল, একটু ওপরে গাছের ডালে অনেকটা হনুমানের মতো দেখতে একজন বসে আছে। হনুমানই, তবে এরও বেশ দেড়হাত লম্বা দাড়ি আর বড় বড় বাবরি চুল। মুখে একটু বিদ্রুপের হাসি।
“কিছু বুঝলে চিতেনবাবু?”
“আজ্ঞে না।”
“মাথা ঝিমঝিম করছে নাকি?”
“করছে।”
“তবু বলি বাপু, তুমি বেশ শক্ত ধাতের লোক। তোমার হবে।”
“কী হবে?”
“যেমন হতে চাও।” এই বলে হনুমানটা চটপট গাছ বেয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি? চিতেন নিজেকে সামলাতে একটু চোখ বুজে রইল। তারপর চোখ মেলে সে সেই আশ্চর্য গাছটা দেখতে পেল। সোজা সরল, ডালপালাহীন বিশাল উঁচু গাছ। পাতায় ঢাকা।
এরকম গাছ সে জীবনে দ্যাখেনি। চিতেন চারদিকটা ফের ভাল করে দেখল। না, এ জায়গাটা ভুতুড়েই বটে! তার ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়েও সে কিছু বুঝতে পারছে না।
একটু আগে বিপিনদাদাকে নিয়ে ভজনবাবু ভাঙা বাড়িটার ভেতরে ঢুকেছেন। সেখানে কী হচ্ছে কে জানে! চিতেন খুবই চিন্তিত মাথায় ধীরে ধীরে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে বাড়িটার দিকে এগোতে লাগল। তবে দুটো বিচিত্র অভিজ্ঞতায় তার হাত-পা মগজ আর আগের মতো কাজ করছে না। ধন্দ লাগছে।
একটু এগিয়ে বাড়িটায় ঢুকবার মুখে দাঁড়িয়ে সেই অদ্ভুত গাছটায় হাতের ভর রেখে দাঁড়াতে গেল চিতেন। অমনই সমস্ত শরীরটায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। চিতেন ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। কী থেকে কী হল সে বুঝতেই পারল না।
কে যেন খুব কাছ থেকে বলে উঠল, “অত বুঝবার দরকারটাই বা কী?”
চিতেন প্রায় কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসে দেখল, একটা দাড়ি আর চুলওয়ালা খরগোশ, তা হাত দুই লম্বা হবে, তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সামনের দু’খানা পায়ে ধরা একটা পেয়ারার মতো দেখতে ফল খাচ্ছে।
চিতেন আর অবাক হল না। কাহিল গলায় বলল, “আপনারা কারা?”
“বললাম তো, বেশি জেনে কাজ নেই। গুপ্তধন চাই তো! যাও না, ওই সোজা পথে ঢুকে যাও। মেলা মোহর আর হিরে-মুক্তো পেয়ে যাবে। ওসব দেওয়ার জন্যই তো আমরা বসে আছি।”
এই বলে খরগোশটা ঝোঁপের আড়ালে অদৃশ্য হল। অন্য কেউ হলে চেঁচামেচি করত, দৌড়ে পালাত। কিন্তু প্রতিভাবানরা তা করে না। আর করে না বলেই তো তারা প্রতিভাবান। চিতেন লম্বা, বেয়াড়া গাছটার দিকে একবার ঘাড় তুলে চেয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে লাগল।
ওদিকে বিপিনবাবুর বাড়িতে খড়ের গাদির মধ্যে গোপাল আর গোবিন্দর কী হল সেটাও দেখা দরকার। ভোররাতে খড়ের ওম পেয়ে দুজনেই একটু ঝিমোচ্ছিল। হঠাৎ গোবিন্দ শুনতে পেল, কে যেন খুব ক্ষীণ গলায় বলছে, “পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল, কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল… ওঠো শিশু মুখ ধোও পরা নিজ বেশ, আপন পাঠেতে মন করহ নিবেশ..রবিমামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ওই… ভোর হল দোর খোলো, খুকুমণি ওঠো রে..আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর…”
গোবিন্দ রক্তচক্ষু মেলে বিরক্তির সঙ্গে বলল, “কে রে এত ভ্যাজরং ভ্যাজরং করে!”
পীতাম্বর গোবিন্দর ঘুম ভাঙানোর জন্য ভোর নিয়ে যত কবিতা
জানা ছিল আউড়ে যাচ্ছিল এতক্ষণ, কাজ হল না দেখে সে এবার গান ধরল। মুশকিল হল, তার গানের গলা তখনও ছিল না, এখনও নেই। বেসুরো গলাতেই সে প্রভাতী গাইতে লাগল, “প্রভাত যামিনী, উদিত দিনমণি, উষারানী হাসিমুখে চায় রে, জাগি বিহগ সব করে নানা কলরব, হরি হরি হরি গুণ গায় রে..”
গোবিন্দ এবার উঠে বসে বলল, “উঃ, এ যে জ্বালিয়ে খেলে দিলে সকালের ঘুমটার বারোটা বাজিয়ে বেসুরো গলায়।”
পীতাম্বর বেশ রাগের গলাতেই ধমক দিল, “শোনো হে বাপু, ছেলেবেলায় রচনার বইতে পড়োনি, যে শুইয়া থাকে তাহার ভাগ্যও শুইয়া থাকে?”
এবার গোবিন্দ সটান হয়ে বসল, এ তো সেই গলা! এ যে তার উপকারী ভূত।